॥ মাসুদ মজুমদার ॥
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে সামাজিক অস্থিরতাকেও উসকে দেয়া হচ্ছে। ঠাণ্ডা মাথায় আলেম-ওলামাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির নানা উপায়-উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পরোক্ষভাবে আলেমদের কোনঠাসা করে দেয়ার মতো তৎপরতাও লণীয়। বাংলাদেশের মতো উদারনৈতিক জমিনে বিয়েতে বর-কনের ধর্মীয় পরিচয় বাদ দেয়া সম্পর্কে ন্যায়সঙ্গত সমালোচনা করে একজন ইমাম ও খতিব চাকরি খুইয়েছেন। এ ধরনের সমালোচনা ও নিন্দা প্রত্যাশিত হলেও ইমাম সাহেব আন্তঃধর্ম বিয়ের কুফল ও ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বক্তব্য দিয়ে ‘অপরাধ’ করেছেন। তাই তাকে সরকারপন্থীদের সাহায্যে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে। যদিও মুসল্লিদের চাপে তাকে পূণর্বহাল করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছেন। তার পরও প্রশ্ন ওঠে ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনকারীরা কারা। ঘটনাটি ঘটেছে জয়পুরহাটে। জয়পুরহাট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম ৪ মে শুক্রবার বিশেষ বিবাহ আইনের বৈধতার প্রশ্ন তুলে বক্তব্য দেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম সাহেব বলেছেন, বিয়েতে বর-কনের ধর্মীয় পরিচয় বাদ দেয়া কুরআন-সুন্নাহর লঙ্ঘন, এ হারাম বিয়ের মাধ্যমে যে সন্তান জন্ম নেবে তা হবে জারজ সন্তান। সব ধর্মের ধার্মিক লোকই এমন বক্তব্য দিতে আগ্রহী। কারণ এতটুকু ধর্মনৈতিক বিধিবিধান না মানলে সামাজিক সঙ্কট তীব্রতর হবে। কোনো ধর্মই আন্তঃধর্ম বিয়েতে সমর্থন যোগায় না।
আমাদের কাছে বোধগম্য নয়, মসজিদে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব কী ভুল বক্তব্য দিলেন। অবশ্য ‘জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে জারজ সন্তানের সৈন্য চাইলে বাংলাদেশ যেন দিতে পারে, এ জন্য এমন আইন তৈরি হচ্ছে’ বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন সেটি একটি পর্যবেক্ষণ। দেশের একজন নাগরিক ও বিজ্ঞ আলেম হিসেবে এমন আইনের ভবিষ্যৎ পরিণতির ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে এমন মন্তব্য করলে দোষের কী আছে। তা ছাড়া তিনি ভুল মন্তব্য করলে সংশোধন করার সুযোগ আছে, সঠিক মন্তব্য করলে বাহবাই পাবেন, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে কেন সেটা বোধগম্য নয়। তাও জোর করে। যারা ইমাম সাহেবের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন তাদেরও কথা বলার ও প্রতিবাদ করার সুযোগ আছে। আমরাও দেখতে চাই, কোন মুসল্লি মসজিদে গিয়ে আন্তঃধর্ম বিয়ে নিয়ে পক্ষে বলতে চানÑ সেটার পক্ষে তার যুক্তিই বা কী?
আমরা জানি না দেশটা সমাজতান্ত্রিক যুগের সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে গেল কি না! সোভিয়েত ইউনিয়নে শত শত মসজিদ ও গীর্জা বন্ধ করে তাতে সমাজতন্ত্রের চাষ কিংবা পানশালা বানানো হয়েছিল, যা সোভিয়েত পতনের পর কিছু কিছু খুলে দেয়া হয়েছে। সোজাসাপটা কথা, বাংলাদেশে আন্তঃধর্ম বিয়ে, বর-কনের ধর্মীয় পরিচয় গোপন করে কিংবা বাদ দিয়ে বিয়ে হতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ এমনকি মাটিও তা মেনে নেবে না। যারা এসব চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন তারা শুধু ভুলই করছেন না, অনাচারকে আশকারা দিয়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির ঐতিহ্য ও সামাজিক স্থিতি নষ্ট করছেন। এই মানসিকতার নষ্ট মানুষগুলো অনাচারকে ও লিভ টুগেদারকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। বাঙালি মুসলমান এমন অনাচারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সরকারি মদদ মেনে নেবে না। সম্মিলিত ওলামা পরিষদ, সমমনা ১২ দল, দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামসহ দলমত নির্বিশেষে তাবৎ আলেম-ওলামা-পীর-মাশায়েশ আন্তঃধর্ম ও বিয়ে নিয়ে সময়োচিত ও সঠিক মন্তব্যই করেছেন। দেশের কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ আলেম যে বক্তব্য দিয়ে দেশ, জাতি ও সরকারকে সতর্ক করেছেন তাও শত ভাগ সঠিক। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, তারা একটি সাহসী বক্তব্য দিয়ে সময়ের প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তঃধর্ম বিবাহ আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলে আলেমসমাজ কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করেনি, তারা সমাজ সংস্কারে আলেমসমাজের প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। বিচ্ছিন্নভাবে কিংবা ব্যক্তি কোনো আলেমের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিছু সুবিধাভোগী ও কায়েমি স্বার্থবাদী দরবারি আলেম সব যুগে থাকে, ছিল, বর্তমানেও আছে। তারা চোখ থাকতে অন্ধ, বিবেক তাদের বন্ধক দেয়া। কিন্তু দেশের সামষ্টিক আলেম সমাজ ধর্মের মৌলিক ইস্যুতে কখনো ভুল করেন না। তারা সব সময় সব জাতীয় কর্তব্য পালন করতে দায়বোধ না করলেও দেশের সামাজিক স্থিতি, অনাচার-ব্যভিচার প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রতিপক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। তারা এক দিকে ধার্মিক অন্য দিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ বরেণ্য মানুষ। তারা নৈতিকতার বিকাশে যতœবান। ইসলাম নিয়ে যেকোনো বাড়াবাড়ি করার বিরুদ্ধেও তারা ভূমিকা পালন করেন। সামাজিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে আলেম সমাজ এই মাটি ও জনপদের মানুষের জন্য এক ধরনের অপরিহার্য অংশ। তারাই চরমপন্থা ঠেকায়। কুসংস্কার প্রতিরোধ করে। তারাই ধর্মীয় জঙ্গিপনা রুখে দিয়েছেন। আবার ধর্মের নামে বজ্জাতি ও বকধার্মিকতা তাদের হাতেই ধরা পড়ে। তারা সরকারকে সতর্ক করেন, জাতিকে সতর্ক করেন; কিন্তু ক্ষমতায় ভাগ বসান না।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আলেমসমাজের অবস্থান এবং বাঙালি মুসলমানের মন বুঝে ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় গতানুগতিক রাজনীতি তাকে প্রশ্রয় দিলেও তার সরকারের ধর্মবিদ্বিষ্ট ও বাড়াবাড়িমূলক নীতি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। তার আশপাশে যেসব আলেম পরিচয়ধারীরা রয়েছেন, তাদের ‘দরবারি’ পরিচয়টি মুখ্য। তারা দালালি করবে, মোসাহেবি করবে, সঠিক পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার মুরোদ দেখানোর মতো নৈতিক তাকদ তাদের নেই।
দুর্ভাগ্য, এসব দিকে নজর না দিলেও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক বক্তব্য দেয়া শুরু করেছেন। এর মাজেজা হতে পারে দুটো। আগাম নির্বাচনের পথ ধরে বর্তমান রাজনৈতিক উত্তাপ প্রশমনের একটি সাধু প্রচেষ্টা। অন্য কারণ হতে পারে দাতা সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রেসার গ্রুপ, দেশের ভেতরকার তৃতীয় শক্তিকে জানান দেয়া যে সরকার আসলে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির না হলেও ভীষণ রকমের গণতন্ত্রপ্রেমী। কারো কিছু করতে হবে না। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর হবে।
কথায় আছে সাধু হও, সাধু সেজো না। রাজনীতিবিদদের কাছে এসব নীতিকথার তেমন কোনো দাম নেই। তারা সাধু-সন্ন্যাস বুঝতে চান না। তবে ধর্ম ব্যবসায় রাজনীতিবিদেরা সবার সামনে থাকতে চান। সেখানে ম্যাকিয়াভ্যালির ধার্মিক না হয়ে ধার্মিক সাজার নসিহত সবাই গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রীকে আবারো জনগণের কাছে যেতে হলে তসবিহ-হিজাব লাগবে। কুরআন-সুন্নাহবিরোধী না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। ধার্মিক ভাব প্রদর্শন করতে হবে।
বাংলাদেশের যথেষ্টসংখ্যক রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বাঙালি মুসলমানের মন বুঝতে চেষ্টা করেননি। বাঙালির রাজনৈতিক চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রেও কার্পণ্য কিংবা সীমাবদ্ধতা প্রচুর। আমাদের সীমাবদ্ধতা নিয়েও বলব, সম্ভবত মরহুম আবুল মনসুর আহমদ ও আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানের মন বুঝতে কিংবা মনটা ছুঁতে চেষ্টা করেছেন। সহজ কথায় বাঙালি মুসলমান স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে, স্বতন্ত্র ধারায় ও আলাদা মেজাজে থাকার সুযোগ না পেলে পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের অস্তিত্ব তেমন কোনো গুণগত গ্রাহ্যের বিষয় ভাবতে রাজি হবে না। পূর্ব বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে গড়ে ওঠার সব প্রচেষ্টা ও প্রেরণায় বাঙালি মুসলমানের আর্তি-আকুতি প্রাধান্য পেয়েছে। এটা নতুন গীত কিংবা পুরনো সাম্প্রদায়িক ভাবনা বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে, লাভ হবে না। কারণ শেষ পর্যন্ত সেই মন ছুঁতে পারেননি বলেই বঙ্গবন্ধুর মতো এক কালের তুখোড় যুব মুসলিম লীগ নেতার উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে গিয়েছিল। এখন প্রধানমন্ত্রীও যদি বাঙালি মুসলমানের মন আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হন, তাহলে রাজনীতি নয়, সামাজিক শক্তির চাপেই তাকে নতশির হতে হবে।
বাংলাদেশে কিছু সামাজিক শক্তি আছে, যারা ক্ষমতা চর্চা করে না, তবে ক্ষমতার পালাবদলে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তারাই নেগেটিভ ভোট প্রয়োগ করে বেশি। আজকাল রাজনীতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ক্ষমতার তখত ওলটপালট হয় সামাজিক শক্তির কারণে। এই সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে আলেম-ওলামারা বাঙালি মুসলমানের মন, মনন ও চেতনার কাছাকাছি অবস্থান করেন।
ধর্ম মানা-না-মানা ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও শাসকেরা ধর্ম নিয়ে কিভাবে কী করেন বিষয়টি সামাজিক শক্তিকে ভাবায়। তাই শাসকেরা ধর্ম না মানলেও এই সামাজিক শক্তিটি প্রতিবাদী হয় না। রাজপথে নামে না, তেমন একটা বাদানুবাদেও যায় না। তবে শাসকেরা ধর্মবিরোধী অবস্থান নিলে, ধর্মবিদ্বেষ লালন করলে, ধর্মবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান ও ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের পথে হাঁটা শুরু করলে তারা ফুঁসে ওঠেন। অতীতেও এই সামাজিক শক্তিটি ফুঁসে ওঠার পর একটি অনিবার্য পরিণতি লক্ষ করা গেছে।
লক্ষ করছি গত কিছু দিন যাবৎ দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও খানকাকেন্দ্রিক লোকগুলোকে বিুব্ধ হতে। সংুব্ধ বিরাট অংশ রাজপথেও নেমেছে। সুযোগ পেলেই তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছে। কারণ জানতে চেয়ে সরাসরি জবাব পাইনি। প্রশ্ন করেছিলাম- কওমি মাদরাসার সংস্কারে সরকারের আগ্রহ থাকলে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে দোষ কী? রুষ্ট মনের ক্ষোভ সঞ্চারি জবাব পেয়েছিÑ এ সরকারকে তারা তাদের বিশ্বাসের প্রতিনিধি কিংবা অনুরূপ কিছু ভাবে না। বরং এ সরকার ধর্মবিদ্বেষী ভূমিকা পালন করে তাদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে যাচ্ছে। এই সরকারের আমলে ধর্ম, ধার্মিকতা, ধর্মীয় লেবাস, দাড়ি টুপি এবং তালেবুল এলেমরা বেশি নিগ্রহ ও কটাক্ষের শিকার হয়েছে। দ্বীনদার মানুষ বেশি নিপীড়িত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তারা সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা বাদ দেয়া, বিসমিল্লাহর অনুবাদ, মুসলিম বিশ্বের সাথে বিশেষ সম্পর্ককে ঝেঁটিয়ে ফেলে দেয়াকে একমাত্র কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চায় না। এসব বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রবেশ করানোর বিষয়টিকে তারা ভালোভাবে নেয়নি। কেন যেন মনে হয়, কওমি মাদরাসা নিয়ে খেলতে গিয়ে সরকার সামাজিক শক্তির একটি বিরাট অংশকে আরো বেশি মাত্রায় ক্ষেপিয়ে তুলেছে।
যারা অনেক কিছু আমলে নেয় না। সব ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। অনেক মৌলিক সমস্যার ব্যাপারেও তারা আগ বাড়িয়ে যায় না। তারাই নারী নীতি, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, ধর্মীয় পরিচয় উপেক্ষা করে বিয়ে-শাদির ব্যবস্থার মতো কিছু স্পর্শকাতর বিষয়কে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। অনেকবার ভাবতে চেষ্টা করেছিÑ দেশে এত সমস্যা, সঙ্কটের শেষ নেই, ঘুষ চলছে, দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে, মন্ত্রীরা পর্যন্ত ঘুষ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে যাচ্ছেন, খুন-গুমের মতো পিলে চমকানো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আলেম-ওলামারা উল্লেখযোগ্য কিছু করছেন না, কিন্তু আন্তঃধর্ম বিয়ে, ফারায়েজনীতি, নারীনীতি, কওমি মাদরাসা শিক্ষার মতো বিষয়গুলো নিয়ে এতটা সোচ্চার কেন। তাদের বিবেচনায় এগুলো অগ্রাধিকার পেল কেন।
বিলম্বে হলেও জবাব পেয়েছি। আসলে আলেম-ওলামারা এমন এক সামাজিক শক্তি, যারা রাজনীতি নয়, সমাজটাকে স্থিতিশীল রাখতে সচেষ্ট। নীতিনৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় শিক্ষার প্রাণস্পর্শী দিকগুলো নিয়ে তাদের ভাবনা বেশি। সরকার যায় সরকার আসে, কিন্তু সমাজের ভিত্তিটা ধসিয়ে দিলে; মৌলিক নীতিবোধ, মূল্যবোধ, ধর্ম ও সাধারণ নৈতিক শিক্ষার গোড়া কেটে দিলে এ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। পুরো সমাজটাকে অনাচার ও অবক্ষয় ঘিরে ধরবে। সামাজিক শৃঙ্খলা বলতে অবশিষ্ট কিছু থাকবে না। সমাজ ভেঙে গেলে রাষ্ট্রও টিকে থাকে না। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে বাধ্য।
যার যার ধর্ম বজায় রেখে লিভ টুগেদার করা যায়, বিয়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ধর্মীয় বন্ধন অর্জন করা যায় না। সন্তানের ধর্ম কী হবেÑ এটা বড় জিজ্ঞাসা নয়Ñ বড় জিজ্ঞাসা এভাবে সামাজিক বন্ধন ও ধর্মীয় বিধান উপেক্ষা করা হচ্ছে কাদের স্বার্থে। কারা এর পৃষ্ঠপোষক। কেনই বা তারা আমাদের সমাজের ভিত, সামাজিক ও ধর্মীয় শৃঙ্খলার শিকড় কেটে দিতে চাচ্ছে। মনে হয় রাজনীতিবিদেরা দেশজ রাজনীতি ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায় ভুলে গেছেন। কিন্তু আলেম-ওলামা রাজনীতি ও ক্ষমতানীতি উপেক্ষা করলেও এ সমাজের শৃঙ্খলা ও নীতিবোধ ধরে রাখার বিষয়টি ভুলে যাননি।
দেশের মানচিত্র পাল্টায়, ইতিহাস পাল্টায় না। সরকার পাল্টায়, সমাজ পাল্টায় না। রাজনীতি পাল্টায়, জনগণের মন ও চৈতন্য পাল্টায় না। তাহলে স্বীকার করতেই হবে, আলেম-ওলামারা মৌলিক সমস্যা বুঝেছেন। এটাকে ধর্মান্ধতা, প্রগতিবিরোধিতা ও মৌলবাদিতা বলে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। পরে পুনর্বহাল হলেও জয়পুরহাটে একজন ইমাম চাকরি হারিয়ে নিজের তাৎক্ষণিক ক্ষতি মেনে নিলেও জাতির চোখ খুলে দিতে ভূমিকা পালন করেছেন। ইজ্জত ও রিজিকের ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়। সরকার আসমানের সাথে সম্পর্ক চুকে দিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অন্য দিকে আলেম-ওলামারা আসমানের সাথে সম্পর্কটা জুড়ে দিতে
চান। এই মনস্তাত্বিক যুদ্ধে আলেমদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
digantaeditorial@gmail.com
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে সামাজিক অস্থিরতাকেও উসকে দেয়া হচ্ছে। ঠাণ্ডা মাথায় আলেম-ওলামাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির নানা উপায়-উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পরোক্ষভাবে আলেমদের কোনঠাসা করে দেয়ার মতো তৎপরতাও লণীয়। বাংলাদেশের মতো উদারনৈতিক জমিনে বিয়েতে বর-কনের ধর্মীয় পরিচয় বাদ দেয়া সম্পর্কে ন্যায়সঙ্গত সমালোচনা করে একজন ইমাম ও খতিব চাকরি খুইয়েছেন। এ ধরনের সমালোচনা ও নিন্দা প্রত্যাশিত হলেও ইমাম সাহেব আন্তঃধর্ম বিয়ের কুফল ও ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বক্তব্য দিয়ে ‘অপরাধ’ করেছেন। তাই তাকে সরকারপন্থীদের সাহায্যে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে। যদিও মুসল্লিদের চাপে তাকে পূণর্বহাল করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছেন। তার পরও প্রশ্ন ওঠে ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনকারীরা কারা। ঘটনাটি ঘটেছে জয়পুরহাটে। জয়পুরহাট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম ৪ মে শুক্রবার বিশেষ বিবাহ আইনের বৈধতার প্রশ্ন তুলে বক্তব্য দেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম সাহেব বলেছেন, বিয়েতে বর-কনের ধর্মীয় পরিচয় বাদ দেয়া কুরআন-সুন্নাহর লঙ্ঘন, এ হারাম বিয়ের মাধ্যমে যে সন্তান জন্ম নেবে তা হবে জারজ সন্তান। সব ধর্মের ধার্মিক লোকই এমন বক্তব্য দিতে আগ্রহী। কারণ এতটুকু ধর্মনৈতিক বিধিবিধান না মানলে সামাজিক সঙ্কট তীব্রতর হবে। কোনো ধর্মই আন্তঃধর্ম বিয়েতে সমর্থন যোগায় না।
আমাদের কাছে বোধগম্য নয়, মসজিদে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব কী ভুল বক্তব্য দিলেন। অবশ্য ‘জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে জারজ সন্তানের সৈন্য চাইলে বাংলাদেশ যেন দিতে পারে, এ জন্য এমন আইন তৈরি হচ্ছে’ বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন সেটি একটি পর্যবেক্ষণ। দেশের একজন নাগরিক ও বিজ্ঞ আলেম হিসেবে এমন আইনের ভবিষ্যৎ পরিণতির ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে এমন মন্তব্য করলে দোষের কী আছে। তা ছাড়া তিনি ভুল মন্তব্য করলে সংশোধন করার সুযোগ আছে, সঠিক মন্তব্য করলে বাহবাই পাবেন, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে কেন সেটা বোধগম্য নয়। তাও জোর করে। যারা ইমাম সাহেবের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন তাদেরও কথা বলার ও প্রতিবাদ করার সুযোগ আছে। আমরাও দেখতে চাই, কোন মুসল্লি মসজিদে গিয়ে আন্তঃধর্ম বিয়ে নিয়ে পক্ষে বলতে চানÑ সেটার পক্ষে তার যুক্তিই বা কী?
আমরা জানি না দেশটা সমাজতান্ত্রিক যুগের সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে গেল কি না! সোভিয়েত ইউনিয়নে শত শত মসজিদ ও গীর্জা বন্ধ করে তাতে সমাজতন্ত্রের চাষ কিংবা পানশালা বানানো হয়েছিল, যা সোভিয়েত পতনের পর কিছু কিছু খুলে দেয়া হয়েছে। সোজাসাপটা কথা, বাংলাদেশে আন্তঃধর্ম বিয়ে, বর-কনের ধর্মীয় পরিচয় গোপন করে কিংবা বাদ দিয়ে বিয়ে হতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ এমনকি মাটিও তা মেনে নেবে না। যারা এসব চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন তারা শুধু ভুলই করছেন না, অনাচারকে আশকারা দিয়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির ঐতিহ্য ও সামাজিক স্থিতি নষ্ট করছেন। এই মানসিকতার নষ্ট মানুষগুলো অনাচারকে ও লিভ টুগেদারকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। বাঙালি মুসলমান এমন অনাচারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সরকারি মদদ মেনে নেবে না। সম্মিলিত ওলামা পরিষদ, সমমনা ১২ দল, দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামসহ দলমত নির্বিশেষে তাবৎ আলেম-ওলামা-পীর-মাশায়েশ আন্তঃধর্ম ও বিয়ে নিয়ে সময়োচিত ও সঠিক মন্তব্যই করেছেন। দেশের কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ আলেম যে বক্তব্য দিয়ে দেশ, জাতি ও সরকারকে সতর্ক করেছেন তাও শত ভাগ সঠিক। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, তারা একটি সাহসী বক্তব্য দিয়ে সময়ের প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তঃধর্ম বিবাহ আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলে আলেমসমাজ কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করেনি, তারা সমাজ সংস্কারে আলেমসমাজের প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। বিচ্ছিন্নভাবে কিংবা ব্যক্তি কোনো আলেমের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিছু সুবিধাভোগী ও কায়েমি স্বার্থবাদী দরবারি আলেম সব যুগে থাকে, ছিল, বর্তমানেও আছে। তারা চোখ থাকতে অন্ধ, বিবেক তাদের বন্ধক দেয়া। কিন্তু দেশের সামষ্টিক আলেম সমাজ ধর্মের মৌলিক ইস্যুতে কখনো ভুল করেন না। তারা সব সময় সব জাতীয় কর্তব্য পালন করতে দায়বোধ না করলেও দেশের সামাজিক স্থিতি, অনাচার-ব্যভিচার প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রতিপক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। তারা এক দিকে ধার্মিক অন্য দিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ বরেণ্য মানুষ। তারা নৈতিকতার বিকাশে যতœবান। ইসলাম নিয়ে যেকোনো বাড়াবাড়ি করার বিরুদ্ধেও তারা ভূমিকা পালন করেন। সামাজিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে আলেম সমাজ এই মাটি ও জনপদের মানুষের জন্য এক ধরনের অপরিহার্য অংশ। তারাই চরমপন্থা ঠেকায়। কুসংস্কার প্রতিরোধ করে। তারাই ধর্মীয় জঙ্গিপনা রুখে দিয়েছেন। আবার ধর্মের নামে বজ্জাতি ও বকধার্মিকতা তাদের হাতেই ধরা পড়ে। তারা সরকারকে সতর্ক করেন, জাতিকে সতর্ক করেন; কিন্তু ক্ষমতায় ভাগ বসান না।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আলেমসমাজের অবস্থান এবং বাঙালি মুসলমানের মন বুঝে ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় গতানুগতিক রাজনীতি তাকে প্রশ্রয় দিলেও তার সরকারের ধর্মবিদ্বিষ্ট ও বাড়াবাড়িমূলক নীতি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। তার আশপাশে যেসব আলেম পরিচয়ধারীরা রয়েছেন, তাদের ‘দরবারি’ পরিচয়টি মুখ্য। তারা দালালি করবে, মোসাহেবি করবে, সঠিক পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার মুরোদ দেখানোর মতো নৈতিক তাকদ তাদের নেই।
দুর্ভাগ্য, এসব দিকে নজর না দিলেও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক বক্তব্য দেয়া শুরু করেছেন। এর মাজেজা হতে পারে দুটো। আগাম নির্বাচনের পথ ধরে বর্তমান রাজনৈতিক উত্তাপ প্রশমনের একটি সাধু প্রচেষ্টা। অন্য কারণ হতে পারে দাতা সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রেসার গ্রুপ, দেশের ভেতরকার তৃতীয় শক্তিকে জানান দেয়া যে সরকার আসলে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির না হলেও ভীষণ রকমের গণতন্ত্রপ্রেমী। কারো কিছু করতে হবে না। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর হবে।
কথায় আছে সাধু হও, সাধু সেজো না। রাজনীতিবিদদের কাছে এসব নীতিকথার তেমন কোনো দাম নেই। তারা সাধু-সন্ন্যাস বুঝতে চান না। তবে ধর্ম ব্যবসায় রাজনীতিবিদেরা সবার সামনে থাকতে চান। সেখানে ম্যাকিয়াভ্যালির ধার্মিক না হয়ে ধার্মিক সাজার নসিহত সবাই গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রীকে আবারো জনগণের কাছে যেতে হলে তসবিহ-হিজাব লাগবে। কুরআন-সুন্নাহবিরোধী না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। ধার্মিক ভাব প্রদর্শন করতে হবে।
বাংলাদেশের যথেষ্টসংখ্যক রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বাঙালি মুসলমানের মন বুঝতে চেষ্টা করেননি। বাঙালির রাজনৈতিক চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রেও কার্পণ্য কিংবা সীমাবদ্ধতা প্রচুর। আমাদের সীমাবদ্ধতা নিয়েও বলব, সম্ভবত মরহুম আবুল মনসুর আহমদ ও আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানের মন বুঝতে কিংবা মনটা ছুঁতে চেষ্টা করেছেন। সহজ কথায় বাঙালি মুসলমান স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে, স্বতন্ত্র ধারায় ও আলাদা মেজাজে থাকার সুযোগ না পেলে পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের অস্তিত্ব তেমন কোনো গুণগত গ্রাহ্যের বিষয় ভাবতে রাজি হবে না। পূর্ব বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে গড়ে ওঠার সব প্রচেষ্টা ও প্রেরণায় বাঙালি মুসলমানের আর্তি-আকুতি প্রাধান্য পেয়েছে। এটা নতুন গীত কিংবা পুরনো সাম্প্রদায়িক ভাবনা বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে, লাভ হবে না। কারণ শেষ পর্যন্ত সেই মন ছুঁতে পারেননি বলেই বঙ্গবন্ধুর মতো এক কালের তুখোড় যুব মুসলিম লীগ নেতার উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে গিয়েছিল। এখন প্রধানমন্ত্রীও যদি বাঙালি মুসলমানের মন আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হন, তাহলে রাজনীতি নয়, সামাজিক শক্তির চাপেই তাকে নতশির হতে হবে।
বাংলাদেশে কিছু সামাজিক শক্তি আছে, যারা ক্ষমতা চর্চা করে না, তবে ক্ষমতার পালাবদলে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তারাই নেগেটিভ ভোট প্রয়োগ করে বেশি। আজকাল রাজনীতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ক্ষমতার তখত ওলটপালট হয় সামাজিক শক্তির কারণে। এই সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে আলেম-ওলামারা বাঙালি মুসলমানের মন, মনন ও চেতনার কাছাকাছি অবস্থান করেন।
ধর্ম মানা-না-মানা ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও শাসকেরা ধর্ম নিয়ে কিভাবে কী করেন বিষয়টি সামাজিক শক্তিকে ভাবায়। তাই শাসকেরা ধর্ম না মানলেও এই সামাজিক শক্তিটি প্রতিবাদী হয় না। রাজপথে নামে না, তেমন একটা বাদানুবাদেও যায় না। তবে শাসকেরা ধর্মবিরোধী অবস্থান নিলে, ধর্মবিদ্বেষ লালন করলে, ধর্মবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান ও ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের পথে হাঁটা শুরু করলে তারা ফুঁসে ওঠেন। অতীতেও এই সামাজিক শক্তিটি ফুঁসে ওঠার পর একটি অনিবার্য পরিণতি লক্ষ করা গেছে।
লক্ষ করছি গত কিছু দিন যাবৎ দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও খানকাকেন্দ্রিক লোকগুলোকে বিুব্ধ হতে। সংুব্ধ বিরাট অংশ রাজপথেও নেমেছে। সুযোগ পেলেই তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছে। কারণ জানতে চেয়ে সরাসরি জবাব পাইনি। প্রশ্ন করেছিলাম- কওমি মাদরাসার সংস্কারে সরকারের আগ্রহ থাকলে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে দোষ কী? রুষ্ট মনের ক্ষোভ সঞ্চারি জবাব পেয়েছিÑ এ সরকারকে তারা তাদের বিশ্বাসের প্রতিনিধি কিংবা অনুরূপ কিছু ভাবে না। বরং এ সরকার ধর্মবিদ্বেষী ভূমিকা পালন করে তাদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে যাচ্ছে। এই সরকারের আমলে ধর্ম, ধার্মিকতা, ধর্মীয় লেবাস, দাড়ি টুপি এবং তালেবুল এলেমরা বেশি নিগ্রহ ও কটাক্ষের শিকার হয়েছে। দ্বীনদার মানুষ বেশি নিপীড়িত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তারা সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা বাদ দেয়া, বিসমিল্লাহর অনুবাদ, মুসলিম বিশ্বের সাথে বিশেষ সম্পর্ককে ঝেঁটিয়ে ফেলে দেয়াকে একমাত্র কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চায় না। এসব বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রবেশ করানোর বিষয়টিকে তারা ভালোভাবে নেয়নি। কেন যেন মনে হয়, কওমি মাদরাসা নিয়ে খেলতে গিয়ে সরকার সামাজিক শক্তির একটি বিরাট অংশকে আরো বেশি মাত্রায় ক্ষেপিয়ে তুলেছে।
যারা অনেক কিছু আমলে নেয় না। সব ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। অনেক মৌলিক সমস্যার ব্যাপারেও তারা আগ বাড়িয়ে যায় না। তারাই নারী নীতি, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, ধর্মীয় পরিচয় উপেক্ষা করে বিয়ে-শাদির ব্যবস্থার মতো কিছু স্পর্শকাতর বিষয়কে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। অনেকবার ভাবতে চেষ্টা করেছিÑ দেশে এত সমস্যা, সঙ্কটের শেষ নেই, ঘুষ চলছে, দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে, মন্ত্রীরা পর্যন্ত ঘুষ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে যাচ্ছেন, খুন-গুমের মতো পিলে চমকানো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আলেম-ওলামারা উল্লেখযোগ্য কিছু করছেন না, কিন্তু আন্তঃধর্ম বিয়ে, ফারায়েজনীতি, নারীনীতি, কওমি মাদরাসা শিক্ষার মতো বিষয়গুলো নিয়ে এতটা সোচ্চার কেন। তাদের বিবেচনায় এগুলো অগ্রাধিকার পেল কেন।
বিলম্বে হলেও জবাব পেয়েছি। আসলে আলেম-ওলামারা এমন এক সামাজিক শক্তি, যারা রাজনীতি নয়, সমাজটাকে স্থিতিশীল রাখতে সচেষ্ট। নীতিনৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় শিক্ষার প্রাণস্পর্শী দিকগুলো নিয়ে তাদের ভাবনা বেশি। সরকার যায় সরকার আসে, কিন্তু সমাজের ভিত্তিটা ধসিয়ে দিলে; মৌলিক নীতিবোধ, মূল্যবোধ, ধর্ম ও সাধারণ নৈতিক শিক্ষার গোড়া কেটে দিলে এ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। পুরো সমাজটাকে অনাচার ও অবক্ষয় ঘিরে ধরবে। সামাজিক শৃঙ্খলা বলতে অবশিষ্ট কিছু থাকবে না। সমাজ ভেঙে গেলে রাষ্ট্রও টিকে থাকে না। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে বাধ্য।
যার যার ধর্ম বজায় রেখে লিভ টুগেদার করা যায়, বিয়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ধর্মীয় বন্ধন অর্জন করা যায় না। সন্তানের ধর্ম কী হবেÑ এটা বড় জিজ্ঞাসা নয়Ñ বড় জিজ্ঞাসা এভাবে সামাজিক বন্ধন ও ধর্মীয় বিধান উপেক্ষা করা হচ্ছে কাদের স্বার্থে। কারা এর পৃষ্ঠপোষক। কেনই বা তারা আমাদের সমাজের ভিত, সামাজিক ও ধর্মীয় শৃঙ্খলার শিকড় কেটে দিতে চাচ্ছে। মনে হয় রাজনীতিবিদেরা দেশজ রাজনীতি ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায় ভুলে গেছেন। কিন্তু আলেম-ওলামা রাজনীতি ও ক্ষমতানীতি উপেক্ষা করলেও এ সমাজের শৃঙ্খলা ও নীতিবোধ ধরে রাখার বিষয়টি ভুলে যাননি।
দেশের মানচিত্র পাল্টায়, ইতিহাস পাল্টায় না। সরকার পাল্টায়, সমাজ পাল্টায় না। রাজনীতি পাল্টায়, জনগণের মন ও চৈতন্য পাল্টায় না। তাহলে স্বীকার করতেই হবে, আলেম-ওলামারা মৌলিক সমস্যা বুঝেছেন। এটাকে ধর্মান্ধতা, প্রগতিবিরোধিতা ও মৌলবাদিতা বলে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। পরে পুনর্বহাল হলেও জয়পুরহাটে একজন ইমাম চাকরি হারিয়ে নিজের তাৎক্ষণিক ক্ষতি মেনে নিলেও জাতির চোখ খুলে দিতে ভূমিকা পালন করেছেন। ইজ্জত ও রিজিকের ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়। সরকার আসমানের সাথে সম্পর্ক চুকে দিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অন্য দিকে আলেম-ওলামারা আসমানের সাথে সম্পর্কটা জুড়ে দিতে
চান। এই মনস্তাত্বিক যুদ্ধে আলেমদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
digantaeditorial@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন