পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১২

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

॥ মাসুদ মজুমদার ॥


নবাব, সম্রাট ও শাসকেরা ভবিষ্যৎ না ভেবে, ভুল করেই ইংরেজদের বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন। সেই সুযোগের অপব্যবহার করে স্বাধীনতা হরণের সুযোগ নিয়েছিল ইংরেজরা। এদের সাথে যোগ দিয়েছিল প্রভু পরিবর্তনকামী দেশীয় বিশ্বাসঘাতক বর্ণবাদী গোষ্ঠী। হয়তো এরাও ভাবতে পারেনি, তাদেরই বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বণিকের মানদণ্ড শাসনদণ্ডে রূপান্তরিত হবে। মুসলিম শাসকেরাও হয়তো এটা ভাবতে পারেননি, ইংরেজদের সহযোগিতা করবে সরকারেরই ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুবিধাভোগী হিন্দু কর্মকর্তা, দিওয়ান, ফৌজদার, মীরজাফর, জগৎশেঠ চক্র- যাদের বিশ্বাস করে মুসলিম শাসকেরা প্রধানমন্ত্রী, সিপাহসালার, ফৌজদার, দিওয়ান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদ দেয়া ছাড়াও নানা ধরনের বাড়তি সুবিধা দিয়েছিলেন। এরাই রাতারাতি প্রভু পরিবর্তনের খেলায় মেতে উঠল। ষড়যন্ত্রকে ষোলোকলায় পূর্ণ করল। ইংরেজদের সাহায্য করে বিশ্বাসঘাতকতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। নিজেরা সাজল বিশ্বাসহন্তা।
আগেই উল্লেখ করেছি, সম্রাট শাহজাহান প্রথম ইংরেজদের হুগলিতে বাণিজ্যকেন্দ্র স'াপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। সেটাকে উপমা ধরে বাংলার সুবাদার শাহজাদা সুজা বার্ষিক মাত্র তিন হাজার টাকা শুল্কের বিনিময়ে ইংরেজদের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় বাণিজ্যের অধিকার দিয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৬৫১ সালের কথা। তারই খেসারত দিতে হয়েছিল ১০৬ বছরের মাথায় পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধ নামের প্রহসন ও বিপর্যয়ের মাধ্যমে। স্বাধীনতা হারিয়ে পৌনে দুই শ’ বছর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ভোগের দায় ছিল সেসব বিশ্বাসঘাতক ও নতজানু শাসকদের।
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, কৌশলগত অবস'ান, জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ ও নিরাপত্তা আমলে না নিয়েই সম্রাট ও সুবাদারেরা ইংরেজদের বাড়তি সুবিধা দিয়েছিলেন। অনেক কিছু না ভেবেই সরলমনে বিশ্বাস করেছিলেন হিন্দু জমিদার, আমাত্য, আমলা ও ফৌজদারদের। তারাই বিশ্বাসভঙ্গ করে পুরো মুসলিম শাসনের ভিত টলিয়ে দিতে শেকড় কেটে দেয়। ইংরেজদের আমন্ত্রণ করে এনে ক্ষমতায় বসিয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়। অবশ্য ক্ষমতালোভী মীরজাফর, জগৎশেঠ চক্রও ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছিলেন ঘসেটি বেগম। যদিও ইংরেজদের বিশেষ সুবিধা দেয়া, অপরাপর ইউরোপীয় বণিকদের উপেক্ষা করা ছিল কূটনৈতিক অদূরদর্শিতাও। তা ছাড়া বাণিজ্য সনদ দেয়ার অনুমোদনটিও স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত ছিল না।
এর ফলে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক ও এ দেশের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছিল। একই সাথে ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করা হয়েছিল। কারণ অন্যদের দ্রব্যমূল্যের ওপর শতকরা সাড়ে তিন টাকা শুল্ক দিতে হতো। তা ছাড়া রাজকোষের শুল্কের ক্ষতি ছিল বেশুমার। প্রথম অবস'ায় বাংলাদেশে ইংরেজদের বাণিজ্যের পরিমাণ ও পরিসর ছিল অল্প। বাড়তি সুবিধা পেয়ে কয়েক বছরের মধ্যে তা বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। তাদের রাজনৈতিক অভিলাষও স্পষ্ট হতে থাকে। এসব বিবেচনা করেই সম্রাট আরোঙ্গজেব ইংরেজ বণিকদের বিশেষ সুবিধা রহিত করলেন। ইংরেজ বণিকেরা দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের প্রণোদনা পেয়ে এই ব্যবস'ার বিরুদ্ধচারণ করতে প্রয়াস পায়। ফলে স'ানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ বাধে। সুবাদার শায়েস্তা খান তাদের প্রতি কঠোর ব্যবস'া অবলম্বন করেন। ইংরেজদের বাড়াবাড়িমূলক আচরণ ও ধৃষ্টতার অভিযোগে বাংলাদেশ হতে তাদের বিতাড়িত করেন। পরে তারা নিজেদের আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়। শায়েস্তা খানের মহানুভবতায় আবার বাংলাদেশে ইংরেজেরা বিনয়ী হয়ে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। এ কারণেই শায়েস্তা খান এখনো বাংলার মানুষের কাছে নন্দিত ব্যক্তিত্ব।
সম্রাট ফররুখশিয়ার হেমিন্টন নামক একজন ইংরেজ চিকিৎসকের চিকিৎসায় সন'ষ্ট হয়ে তাকে কিছু ইনাম বা পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন। সুচতুর ইংরেজ চিকিৎসক নিজের জন্য কিছু না চেয়ে তার স্বজাতীয় বণিকদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রার্থনা করেন। সম্রাট ১৭১৫ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে মাত্র তিন হাজার টাকা বার্ষিক শুল্কের বিনিময়ে ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্যের অধিকার দান করেছিলেন, যা আগেই উল্লেখ করেছি। একতরফা বাণিজ্যের সুযোগ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ ও ঐশ্বর্যের বলে ইংরেজদের বাণিজ্য ফেঁপেফুলে ওঠে। বণিকেরা রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পায়। সাথে সহযোগী হিসেবে পায় হিন্দু জমিদারসহ আমাত্যদের।
বাণিজ্যে উন্নতির সাথে সাথে ইংরেজ বণিকদের মনে এ দেশে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষার উদয় হয়। হিন্দু ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্কের ফলে তারা বুঝতে পারে, তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা কার্যকর করতে এরা হিন্দু জমিদার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতা লাভ করতে সমর্থ হবে। নবাব আলীবর্দীর রাজত্বকালে কর্নেল স্কট নামের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোলন্দাজ বাহিনীর একজন ইঞ্জিনিয়ার বিলাতের কর্তৃপক্ষের কাছে এক পত্রে লিখেছিলেন, ‘যদি ইউরোপীয় সৈন্যরা ভালোভাবে অভিযান শুরু করে এবং হিন্দুদের উৎসাহিত করা হয়, তাহলে তারা ইংরেজদের সাথে যোগ দেবে।’ তিনি আরো লিখেছিলেন, এই কাজে উমিচাঁদ ও অন্য হিন্দু প্রধানদের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। হিন্দু জমিদার ও রাজকর্মচারীদের ওপর তাদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি আছে।
ইউরোপীয় অস্ত্রশস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে ইংরেজ বণিকদের দৃঢ় আস'া ছিল এবং হিন্দুদের সহযোগিতা সম্বন্ধেও তাদের আশা ও ভরসা দুটোই ছিল। এ জন্যই তারা আলীবর্দীর রাজত্বের শেষের দিকে ধৃষ্টতার সাথে নবাবের আদেশ উপেক্ষা করতে সাহসী হয়েছিল। আরো জানার বিষয় হচ্ছে, কলকাতায় ইংরেজদের জমিদারি ছিল, এরা এর সব অধিবাসীর ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করত। নবাব আলীবর্দী এ ব্যাপারে ইংরেজ বণিকদের কাছে একটি পরওয়ানা পাঠান। এরা পরওয়ানাবাহকের প্রতিও দুর্ব্যবহার করে। এখানেই তাদের ধৃষ্টতার শেষ নয়, তারা নবাবের কাছে অশ্লীল ভাষায় লিখিত এক পত্রে কলকাতার জনগণের ওপর তাদের সার্বভৌমত্ব দাবির বিষয়ে বাড়াবাড়িমূলক ব্যাখ্যা করে। এর কিছু দিন পরে আলীবর্দী খানের মৃত্যু হয়। এই জন্য সাহস ও দেশপ্রেমমূলক দৃঢ়তা থাকলেও আলীবর্দী খান বাধ্যক্যের কারণে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো রূপ ব্যবস'া অবলম্বন করতে পারেননি। সেটাই ছিল ষড়যন্ত্রের শেকড় উপড়ে ফেলার উপযুক্ত সময়- ইংরেজরা যার সদ্ব্যবহার করেছিল।
মাতামহের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালে তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে এক দিকে ইংরেজ বণিকদের অবাধ্যতা, শত্রুতা এবং অন্য দিকে স্বার্থান্বেষী আত্মীয়স্বজন ও রাজকর্মচারীদের ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়। আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘসেটি বেগম নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলেন। ক্ষমতালোভী সেনাপতি মীরজাফরও তার সাথে যোগ দিলেন। তারা সিরাজকে সিংহাসনচ্যুৎ করে সিরাজের খালাতো ভাই ও পুর্নিয়ার শাসনকর্তা শওকতজঙ্গকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসাতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। সে সময় ইংরেজ বণিকেরা নবাবের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সুযোগ পুরো মাত্রায় ছিল। তারা নবাবের কর্তৃত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাতে উৎসাহিত হয়। এ সম্পর্কে মিস্টা কুক লিখেছেন, সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনারোহণের সময় ইংরেজ বণিকেরা চলতি প্রথামত আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে নবাবকে কোনো উপঢৌকন পাঠায়নি। তা ছাড়া তারা নবাবের অনুমতি ছাড়াই কলকাতা দুর্গের আয়তন বাড়ায়। একই সাথে ফোর্ট উইলিয়ামকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সুরক্ষিত করে তোলে।
ইংরেজেরা বাহ্যত দেখায় যে, এরা ফরাসি বণিকদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এসব ব্যবস'া অবলম্বন করছে। কিন' নবাবের অনুমতি না নিয়ে তার রাজ্যে দুর্গ নির্মাণ ও যুদ্ধের আয়োজন করে। এরা নবাবের কর্তৃত্বের প্রতিও চরম ধৃষ্টতা ও উপেক্ষা প্রদর্শন করে। এ ছাড়া ইংরেজেরা দস্তক নামে বাণিজ্য সনদের সুবাদে পাওয়া সুবিধার অপব্যবহার করে। বাদশাহী ফরমানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টকে অধিকার দেয়া হয়েছিল, তিনি ইংরেজ বণিকদের ব্যবসায়ের জন্য অনুমতি পত্র দেবেন এবং দস্তকধারীদের তাদের পণ্যদ্রব্যের জন্য খেয়াঘাটে ও নদীতে শুল্ক দিতে হবে না। কোম্পানির ইংরেজ বণিক ছাড়াও তাদের কর্মচারী ও অন্য সমপ্রদায়ের বণিকেরা দস্তকের সুবিধা অপব্যবহার ও ভোগ করত। এর ফলে রাজকোষের শুল্কের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছিল। উল্লিখিত কারণ ছাড়াও নবাবের যেসব অসৎ ও বিদ্রোহী প্রজা তহবিল তসরুপ কিংবা রাজদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত হতো অথবা শাস্তির ভয়ে কলকাতায় পালাত ইংরেজ কোম্পানি তাদের আশ্রয় দিত। জাহাঙ্গীরনগরের দিওয়ান রাজা রাজবল্লভ রাজকোষের তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে তার অর্থসম্পদ ও পরিবারসহ পুত্র কৃষ্ণদাসকে কলকাতার ইংরেজদের দুর্গে আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়। নবাব ইংরেজদের বেআইনিভাবে দস্তক ব্যবহার বন্ধ করতে বলেন। বিনানুমতিতে দুর্গ নির্মাণ করতে নিষেধ করেন। কৃষ্ণদাসকে ফিরিয়ে দিতে ইংরেজদের আদেশ দেন। কোম্পানির কলকাতার গভর্নর মিস্টার ড্রেক নবাবের সব আদেশ অমান্য করে। অধিকন' নবাবের পাঠানো দূতের সাথে অসৌজন্য আচরণ করে।
বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য নবাব ইংরেজদের অবাধ্যতার শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ নিলেন। ১৭৫৬ সালের ৪ জুন তিনি তাদের কাসিমবাজার বাণিজ্য কুঠি দখল করে নেন। ২০ জুন তাদের কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গও অধিকার করেন। অনেক ইংরেজ কলকাতা ছেড়ে নদীতে ভাসমান জাহাজে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কিছু ইংরেজ নবাবের হাতে বন্দী হয়। মিস্টার কুক লিখেছেন, নবাব ইংরেজ বন্দীদের প্রতি কোনো রূপ দুর্ব্যবহার করেননি। মিস্টার ড্রেক উল্লেখ করেছেন, ভিন্ন কথা। হলওয়েল সামান্য ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে ‘অন্ধকূপ হত্যার’ কাহিনী সাজিয়েছিলেন।
কলকাতার পতনের পর ড্রেক ও অন্যান্য ইংরেজ সাহেব আশ্রয়হীন ও অসহায় হয়ে পড়ে। এ সময় এরা যদি উমিচাঁদ, নবকিষণ, জগৎশেঠ ও অন্যান্যের সাহায্য না পেত তা হলে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না। কয়েকজন হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ী পলাতক ইংরেজদের ফুলতায় আশ্রয় দেয় এবং তাদের জন্য গোপনে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করে।
কলকাতা পতনের খবর পেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজ কাউন্সিল রবার্ট ক্লাইভের অধীনে বাংলাদেশে সৈন্যদল ও নৌবহর পাঠায়। ক্লাইভ দাক্ষিণাত্যে ফরাসি বণিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে কর্ণাটকে ইংরেজ বণিকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটস ১৭৫৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর নৌবহর নিয়ে ভাগীরথী নদীতে প্রবেশ করে এবং ফুলতার দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় নবাবের ফৌজদার মানিকচাঁদ তাদের কোনো রূপ বাধা দেয়নি। এই সময়টিতে মানিকচাঁদ ও ক্লাইভের মধ্যে যে পত্র ও বার্তাবাহক বিনিময় হয় তা থেকে জানা যায়, মানিকচাঁদ নিজেকে ইংরেজদের একজন বন্ধু বলে প্রকাশ করে। ফলে ২ জানুয়ারি ১৭৫৭ সালে ক্লাইভ বিনা বাধায় সহজে কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এর পর ক্লাইভ হুগলি অধিকার করতেও কোনো বাধা পায়নি। মানিকচাঁদ ইরেজদের সাথে যুদ্ধ না করে কলকাতা ও হুগলি থেকে পূর্বপরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র মতো ইংরেজদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে নিজে সসৈন্য পিছু হটে যায়।
বাধ্য হয়ে নবাবকেই আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে হলো। ইরেজরা হুগলি ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। নবাব কলকাতার শহরতলিতে প্রবেশ করেন। ১৭৫৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ক্লাইভ ও ওয়াটস অতর্কিত নৈশ-আক্রমণে নবাবের সেনাছাউনিতে কিছুটা গোলযোগ সৃষ্টি করার সুযোগ নিলেও অবস'া প্রতিকূল বুঝে ক্লাইভ পালিয়ে যায়। কলকাতা অভিযানের পক্ষে নবাবের পর্যাপ্ত জনবল ও সৈন্য ছিল। কিন' তিনি নিজ সেনাকর্মকর্তাদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। এরা নবাবকে ইরেজদের সাথে আপস করতে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিল। এই সময় নবাবের আরেকটি বিপদের আশঙ্কা দেখা দেয়। আশঙ্কা করা হয়, আহমদ শাহ আবদালি বিহার আক্রমণে অগ্রসর হচ্ছেন। এতে নবাব মনের বল হারিয়ে ফেলেন। এক দিকে সেনাকর্মকর্তা ও ফৌজদার মানিক চাঁদ ইংরেজদের হয়ে কাজ করছিল, অন্য দিকে আহমদ শাহ আবদালির আক্রমণ শঙ্কা, বাধ্য হয়ে নবাব ১৭৫৭ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি ইংরেজদের সাথে সন্ধি করেন। এটাই বিখ্যাত ‘আলীনগরের সন্ধি’ নামে পরিচিতি।
ইংরেজেরা বাণিজ্যসুবিধা ফিরে পায়। কলকাতার দুর্গ সুরক্ষিত করার অনুমতিও তারা আদায় করে নেয়। এই সন্ধি করিয়ে নবাবকে যে দুর্বলতার পরিচয় দিতে বাধ্য করা হয় তারই পরিণতি ছিল অনিবার্য বিপর্যয়। যদি নবাব এই সময় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বিশ্বাসঘাতক সেনাধ্যক্ষদের শাস্তির ব্যবস'া করতে পারতেন, তাহলে তারা ভয় পেয়ে ষড়যন্ত্রমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হতো। কারণ তখনো ইংরেজরা সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারেনি। তাৎক্ষণিক কলকাতার দুর্গ আক্রমণ করলে নবাবের জয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। সব যড়যন্ত্র তখনই নিপাত যেত। বিশ্বাসঘাতক চক্রও খামোশ হয়ে যেতে বাধ্য হতো। বাংলার ইতিহাসও রচিত হতো ভিন্নভাবে।
ধুরন্ধর ইংরেজরা কেবল সাময়িকভাবে যুদ্ধবিরতির জন্য নবাবের সাথে সন্ধি করেছিল। মাত্র এক মাস পরেই এরা আলীনগরের সন্ধি ভঙ্গ করে। উল্লেখ্য, ১৭৫৬ থেকে ৬৩ সাল পর্যন্ত ইউরোপে তখন ‘সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ’ চলছিল। বাংলাদেশে ইংরেজরা ফরাসিদের চন্দরনগর বাণিজ্যকুঠি আক্রমণের জন্য প্রস'ত হয়। নবাব ইংরেজ ও ফরাসিদের তার রাজ্যে যুদ্ধ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। নবাবের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ক্লাইভ ২৩ মার্চ চন্দরনগর আক্রমণ করে দখল করে নেয়। হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সেনাপ্রধান রায়দুর্লভ ও মানিকচাঁদ ইংরেজদের সামান্যতম বাধা দিতে চেষ্টা করেনি। এ ব্যাপারে স্ক্রেফটন সাহেব লিখেছেন, ইংরেজরা উমিচাঁদকে দিয়ে নন্দকুমারকে এক হাজার ৫০০ টাকা ঘুষ দিয়েছিল। নন্দকুমার নবাবের সামরিক তথ্যও ইংরেজদের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছিল। তাতে ইংরেজদের শক্তি ও সাহস দুটোই বেড়ে যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য এক গোপন প্রস্তাব পাস করে। মিস্টার হিল লিখেছেন, ক্লাইভ উমিচাঁদকে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করেন। নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর নবাবের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন না। নবাব আলীবর্দীর সময় থেকেই মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কুখ্যাতি ছিল। তাকে কয়েকবার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নবাবের কাছে শাস্তিও পেতে হয়েছিল। মীরজাফর আলিবর্দীর ভগ্নিপতি ছিলেন। এই জন্য বৃদ্ধ নবাব তাকে ক্ষমা করে আবার সেনাপতি পদে বহাল করেন। কিন' মীরজাফরের স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি। মুর্শিদাবাদের মসনদের প্রতি তার লোভ ছিল। সিংহাসনের লোভে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে ষড়যন্ত্রকারীরা জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, মীরজাফর, রাজবল্লভ এবং আরো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সেই গোপন বৈঠকে যোগ দেন। ইংরেজ কোম্পানির অ্যাজেন্ট ওয়াটস মহিলাদের মতো পর্দাঘেরা পালকিতে চড়ে সেই বাড়িতে আসেন। সেখানেই বাংলার স্বাধীন নবাব ও স্বাধীনতার ভাগ্য নির্ধারণ করে ষড়যন্ত্রকারীরা।
আজকাল অনেক সন্ধি হচ্ছে। গোপন আঁতাত হচ্ছে। চুক্তি হচ্ছে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক সুবিধা পাইয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা এসব করছেন তারা অতীত ভাবছেন না। ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বিগ্ন নন। বাংলাদেশ আবার বিদেশীদের বাজারে পরিণত হলেও তাদের উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয় না। আজকের প্রেক্ষাপটে নন্দকুমার, মানিক চাঁদ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ ও মীরজাফর চক্রের মতো কারা কার স্বার্থের ক্রীড়নক তা-ও আমরা জানি না। শঙ্কা জাগে- ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে না তো?
কারণ কূটনৈতিক অদূরদর্শিতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। একতরফা বাণিজ্যিক সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ। গোপন বন্ধুত্বের অনেক তথ্যই অজ্ঞাত। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ ও বন্ধুত্বের কাছে হার মানছে। জাতি বিভক্ত। চার দিকে ষড়যন্ত্রের নানা গুজব। ব্যর্থতার নানা গুঞ্জন ও কাহিনী নিয়ে রাজনৈতিক ময়দান অসি'র। শাসকদের মেরুদণ্ড এবং ভবিষ্যৎ ভাবনাও প্রশ্নবিদ্ধ। তাই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির শঙ্কা জাগাটা অস্বাভাবিক না-ও হতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন