স্বাধীনতা ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এর স্বরূপ চিহ্নিত করা কঠিন হলেও জাতীয় স্বাধীনতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করা কঠিন নয়। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞান জাতীয় তথা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার স্বরূপ চিহ্নিত করে দিয়েছে। জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে। একটি জাতিসত্তা বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে সি'তি পায়। স্বাধীনতাও অর্জন করে অনেক পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে। এটা অর্জন করতে হয়। তাই স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়। আবার স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাসও রয়েছে। আমরাও একসময় স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম। এখন আমরা এ ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশীদার। আমাদের ইতিহাসে স্বাধীনতা অর্জন ও হারানোর কথা স্পষ্ট করে লেখা আছে।
আমাদের স্বাধীনতার একটি প্রলম্বিত ইতিহাসও আছে। একটা সময় আমরা স্বায়ত্তশাসিত ছিলাম। কিছু সময় আক্ষরিক স্বাধীনতাও আমাদের ছিল। তবে স্বশাসিত বলতে যা বুঝায় তা আংশিক ছিল ’৪৭ সালে, অবশিষ্টটুকু আমরা অর্জন করি ’৭১ সালে। দীর্ঘ সময় আমরা আবার পরাধীনও ছিলাম। আবার ’৪৭ সালে ব্রিটিশমুক্ত দেশ বিভাগের মাধ্যমে পাক-বাংলা-ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। এরপর শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ’৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমরা বাংলাদেশ অর্জন করলাম।
আজ যারা আমাদের ইতিহাস রচনায় ’৭১ সালকে ভিত্তি ধরেন, কিংবা ’৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত টেনে স্বাধীনতার গল্প শোনান, তারা আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করেন, শেকড়বিহীন একটি জাতিসত্তার কাহিনী রচনা করেন। তাতে আমরা শেকড়বিহীন হয়ে যাই।
আমাদের সব জাতীয় নেতা, বাংলাদেশের স'পতি, স্বাধীনতার ঘোষক, সর্বাধিনায়ক সবাই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। ইতিহাসের উত্তরাধিকার। তাদের অনেকেই ব্রিটিশ-মুক্তির মাধ্যমে আজাদি অর্জনের লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ অংশীদার। পাকিস্তান আমলেও তারা ছিলেন বরেণ্য ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তারা কেউ বৃন্তচ্যুত মানুষ নন। যারা আমাদের ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চান তারাই আমাদের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন করে দিতে অতি আগ্রহী। ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা বা আজাদির পঁয়ষট্টি বছর পালনের অংশীদার ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ। বাংলাদেশ সেই ইতিহাস কার স্বার্থে বিসর্জন দিতে যাবে। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা ব্রিটিশ মুক্তির বা স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামমুখর সমৃদ্ধ অতীত কাউকে কেউ দিয়ে দিতে পারে না, সেটাও ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের গৌরবময় অর্জন, স্বাধীনতার লাগাতার বা ধারাবাহিক ইতিহাসেরই অংশ। সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দিলে আমরা হয়ে যাবো পাক-ভারত যুদ্ধের বাই প্রোডাক্টর জনপদ- যা সত্যও নয়, বাস্তবও নয়। অথচ এই উপলব্ধি ও বোধ অনেকেরই নেই।
’৪৭ সালে একটি স্বাধীন দেশের অংশ হিসেবে মানচিত্র অঙ্কিত হয়েছিল বলেই আজ আমরা সেই মানচিত্রের গর্বিত উত্তরাধিকার। সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলা, বাঙালি, বাঙালি মুসলমান, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। ঢাকা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার রাজধানী। পশ্চিম বাংলা ভারতের অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশ। হিন্দির আধিপত্য ও দিল্লির শাসন তাদের ললাটের লিখন। ’৪৭ সালে ঢাকাকেন্দ্রিক এই মানচিত্র অঙ্কিত না হলে আজ আমরা পিন্ডি, ইসলামাবাদ কিংবা দিল্লির অধীন থাকতাম। স্বাধীনতার অহঙ্কার ও জাতিসত্তার আলাদা মর্যাদা অর্জন করা কতটা সম্ভব হতো পশ্চিম বাংলার পরিসি'তি পাঠ করে সেটা উপলব্ধি করার প্রয়োজন পড়ে। সেই পাঠ কিংবা অনুসন্ধান- পর্যবেক্ষণের দায় নতুন প্রজন্মের ওপর বর্তায়।
আমরা ইতিহাসের অতীত পর্বের সাথে আমাদের বর্তমানের যোগসূত্রের স্বরূপ অন্বেষণ করতে চাই। প্রাসঙ্গিকতায় মুসলিম শাসন ও ইংরেজ শাসনের সংক্ষিপ্ত স্বরূপও উন্মোচন করতে চাই। ইংরেজরা সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাণিজ্য করার লক্ষ্যে বাংলায় আগমন করে। ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর একটি রাজকীয় সনদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় দি ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরে কোম্পানি বাণিজ্য করার সুবাদে বাংলার শাসনক্ষমতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীন অস্তিত্ব হাতিয়ে নেয়। সেই ইতিহাসচর্চার আগে আমরা বাংলায় মুসলিম শাসনের ওপর খানিকটা আলোকপাত করতে পারি।
মূলত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে অর্থাৎ ১২ ’শ তিন কি চার সালে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলায় মুসলিম রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ও তার পরবর্তী শাসকেরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ শাসন করেছেন। তারা নামমাত্র দিল্লির সুলতানদের বশ্যতা স্বীকার করতেন। এরপর ১৩৪২ থেকে ১৩৫৭ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর হাজী শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ দিল্লির সাথে নামমাত্র সম্পর্কটুকুও ছিন্ন করে বাংলায় স্বাধীন রাজত্ব স'াপন করেন এবং স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করেন। এই সময় থেকে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল। এই স্বাধীন শাসনের আওতায় বাংলার রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত ঐক্যের পথ সুগম হয় এবং বাঙালির স্বতন্ত্র জাতীয় জীবন গড়ে উঠতে সুযোগ পায়। ১৫৪০ থেকে ৪৫ সাল পর্যন্ত শেরশাহের শাসনকালে কয়েক বছর আবার বাংলাদেশ দিল্লির সাথে সংযুক্ত ছিল। কিন' শেরশাহের মৃত্যুর পর কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ আবার এর স্বাধীন রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসে। পুনরায় মোগল সম্রাট আকবরের সময় আর একবার উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের সাথে স্বাধীন বাংলার সঙ্ঘাত বাধে। ১৫৭৬ সালে মোগল সৈন্যবাহিনী রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ কররানিকে পরাজিত ও নিহত করে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও মোগল সেনাপতিরা বহু বছর চেষ্টা করেও বাংলাদেশে সম্রাট আকবরের দিল্লিকেন্দ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বাংলার স্বাধীনতাপ্রিয় জমিদারেরা তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ১৬১১ সালে তার সুবাদার ইসলাম খানের কর্মকুশলতার ফলে বাংলার জমিদারেরা বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। আবার দিল্লির সাথে সংযোগ স'াপিত হয়।
সেই সুবাদে প্রায় শতাব্দীকাল বাংলাদেশ মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত সম্রাট আরওঙ্গজেব ভারতের শাসন পরিচালনা করেন। সম্রাট আরওঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তার বিশাল সাম্রাজ্য উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা, আমীর-ওমরার ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ প্রভৃতি কারণে বহুলাংশে ভেঙে পড়ে। এই সুযোগে বাংলাদেশে স্বাধীন শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭১৭ থেকে ২৭ সাল পর্যন্ত সুবাদার মুর্শিদ কুলী খান বাংলাদেশে স্বাধীন রাজত্ব স'াপন করেন। তিনি ও তার উত্তরাধিকারীগণের মধ্য থেকে সুজাউদ্দীন ১৭২৭-৩৯ সাল পর্যন্ত, সরফরাজ খান পরবর্তী এক বছর, আলীবর্দী খান ১৬ বছর ও সিরাজউদ্দৌলা মাত্র এক বছর নামমাত্র মোগল সম্রাটদের আনুগত্য স্বীকার করতেন। তারা বাংলার নবাব ও মুর্শিদাবাদের নবাব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মুর্শিদ কুলী খান ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে বাংলাদেশের রাজধানী স'ানান্তরিত করেন। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা মুর্শিদাবাদের নবাবদের রাজ্যভুক্ত ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবদের শাসনকালে বাংলাদেশ জাতীয় জীবন পুনর্গঠনে আবার সুযোগ পায়। এই সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা সঙ্ঘটিত হয়। মুসলমান শাসকশ্রেণী বাঙালির জাতীয় জীবনের সাথে মিশে যায়। মুর্শিদ কুলী ও তার উত্তরাধিকারীরা বাংলাদেশকে তার নিজের দেশ বলে গ্রহণ করেন এবং এখানকার অধিবাসীদের স্বার্থ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে এক হয়ে যান। তাদের আত্মীয়স্বজন, আমীর-ওমরা ও অনুচরেরা এবং ইরান-তুরান হতে আগত ভাগ্যান্বেষী ব্যবসায়ী, আলেম ওলামা ও অন্যান্য শ্রেণীর লোকজন বাংলাদেশে স'ায়ীভাবে বসতি স'াপন করেন। সেই সময় উত্তর ভারতে ও ইরানে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা চলছিল তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বহু ইরানি পরিবার নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। তারা ঐশ্বর্যশালী বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এর ফলে মুর্শিদাবাদ, হুগলি, ঢাকা ও অন্যান্য কয়েকটি শহরে ইরানি প্রভাবও পড়েছিল, যা আজো টিকে আছে।
মুর্শিদ কুলীর আগে বাংলাদেশ শাসনের জন্য উত্তর ভারত থেকে সুবাদার, দিউয়ান, বখশি ও অন্যান্য উচ্চপদস' কর্মচারী প্রেরিত হতেন। তারা আমলা হিসেবে স্বল্প মেয়াদে এই প্রদেশে আসতেন এবং মেয়াদ শেষে উত্তর ভারতে চলে যেতেন। এ জন্য বাংলাদেশের সাথে তাদের যোগসূত্র ছিল না। তাদের সাথে কিছু অর্থসম্পদও উত্তর ভারতে চলে যেত। নবাবদের আমলে এই পথ বন্ধ হয়ে যায়। তাদের সম্পদ বাংলাদেশের উপকারে আসে এবং স্বাধীন বাংলার স্বার্থের সাথে সবার স্বার্থ একসূত্রে গ্রথিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীন সুলতানদের মতো মুর্শিদাবাদের নবাবেরা দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত হয়ে বেশ কিছু জাতীয় নীতি অনুসরণ করে দেশের কল্যাণের জন্য চেষ্টা করেছেন। তারা বাঙালিদের প্রতিভার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক উন্নতির পথ সুগম করে দিয়েছেন। শাসনকার্যের বিভিন্ন পদে তারা ধর্মীয় বিভেদ না রেখেই বাঙালিদের নিয়োগ করতেন।
নবাবদের জাতীয় নীতির ফলে রাজকার্য, জমিদারি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হিন্দুদের বিশেষ উন্নতি হয়। মোগল আমলে বহু জায়গির ও জমিদারি মুসলমানদের দখলে ছিল। বড় বড় জায়গিরদার ও জমিদারদের বেশির ভাগই মুসলমান ছিলেন। মুর্শিদ কুলী অনেক মুসলমান কর্মচারীর জায়গির বাংলাদেশ থেকে উড়িষ্যায় স'ানান্তরিত করেন। কয়েকজন মুসলমান জমিদার রীতিমতো রাজস্ব আদায় করতে অসমর্থ হওয়ায় তিনি তাদের জমিদারি কেড়েও নেন এবং সেসব জমিদারি হিন্দুদের বন্দোবস্তি দেন। মাহমুদপুর বা নদীয়া-যশোর ও জালালপুর পরগনার কয়েকটি মুসলমান জমিদারি নাটোর জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা রামজীবনকে দেয়া হয়। সোনারগাঁওয়ের ঈসা খানের বংশধরদেরও কয়েকটি মূল্যবান পরগনা হারাতে হয়। মুর্শিদ কুলী তাদের জমিদারির আলপশাহী ও মোমেনশাহী পরগনা দু’টি কেড়ে নেন। দুইজন রাজস্ব কর্মচারীর সাথে পরগনা দু’টি বন্দোবস্তির ব্যবস'া করেন। এই ব্যবস'ার ফলে আলপশাহী ও মোমেনশাহীতে দু’টি প্রতাপশালী হিন্দু জমিদারির উৎপত্তি হয়। মুর্শিদ কুলী মনে করতেন হিন্দুরা স্বভাবত মুসলিম শাসকদের প্রতি অনুগত থাকেন। এ জন্য তিনি রাজস্ব ব্যবস'ার বিষয়ে হিন্দুদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করতেন। যদিও তার এই মনে করার সুযোগ নিয়ে হিন্দু জমিদারেরা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন এবং মুর্শিদ কুলী ও পরবর্তী নবাবদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেছেন। মুর্শিদ কুলীর পরবর্তী নবাবেরাও তার প্রদর্শিত নীতি অনুসরণ করে চলেন। এর ফলে বাংলাদেশের জমিদারিতে প্রায় এককভাবে হিন্দুদের প্রাধান্য স'াপিত হয়। এই প্রাধান্যের অপব্যবহার করে হিন্দু জমিদারেরা পরে ইংরেজদের সাথে সখ্য গড়ে তোলেন। তখনই এ দেশে একটি অভিজাত হিন্দু জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়। রাজশাহীর দিঘাপতিয়া ও নাটোর, ময়মনসিংহের মোমেনশাহী ও মুক্তাগাছা এবং দিনাজপুর, নদীয়া ও বর্ধমানের জমিদারিগুলো এর অন্যতম। এরাই পরে মুসলিম শাসকদের বিপক্ষে ইংরেজদের হয়ে ষড়যন্ত্র করার সুযোগ পান। অভিজাত হয়ে ওঠা হিন্দু জমিদারেরা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সহযোগিতাকে প্রভু পরিবর্তন হিসেবে দেখেছিলেন।
মুর্শিদ কুলী হিন্দুদিগকে রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বপূর্ণ পদেও নিয়োগ করেন। তার শাসনকালে ভূপৎ রায়, দর্পনারায়ণ, রঘুনন্দন, কিঙ্কর রায়, আলমচাঁদ, লাহারীমল, দিলপৎ সিংহ, হাজারীমল এবং আরো কয়েকজন হিন্দু দিউয়ান ও অন্যান্য উচ্চ পদে নিযুক্ত হন। মুর্শিদ কুলীর জামাতা ও উত্তরাধিকারী নবাব সুজাউদ্দিনের আমলেও আলমচাঁদ, জগৎশেঠ, যশোবন্ত রায়, রাজবল্লভ, নন্দলাল এবং আরো অনেক হিন্দু কর্মচারী দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নবাব আলীবর্দী খান একই নীতি বহাল রাখেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলাও তার মাতামহের নীতি অনুসরণ করেন। তিনি মোহনলালকে প্রধানমন্ত্রী ও জানকীরামকে দিউয়ানের পদে নিয়োগ করেন। রায়দুর্লভ, রামনারায়ণ, রাজবল্লভ ও অন্যান্য হিন্দু কর্মচারীরা দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা মানিকচাঁদ ও নন্দকুমারকে যথাক্রমে কলকাতা ও হুগলির ফৌজদার পদে নিয়োগ করেন। শেষ পর্যন্ত মোহনলাল ছাড়া আর কোনো হিন্দু জমিদার, আমলা, ঊর্ধ্বতন রাজ কর্মচারী ও ফৌজদার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পাশে দাঁড়াননি; বরং বিশ্বাসঘাতকতাকেই সুযোগ ভেবেছেন।
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও হিন্দুরা বিশেষ সুবিধা লাভ করেছিল। নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুর্শিদাবাদের শেঠ পরিবার ও কলকাতার উমিচাঁদ পরিবার ফেঁপেফুলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। জগৎশেঠ ছিলেন নবাব সরকারের ব্যাঙ্কার। সরকারি লেনদেনের কাজ করে তিনি বছরে সেই সময় এককভাবে চল্লিশ লাখ টাকা মুনাফা করতেন। জগৎশেঠের ঐশ্বর্যের বিষয়ে রবার্ট ওর্ম লিখেছেন, ‘মুকসুদাবাদে তথা মুর্শিদাবাদে এক হিন্দু পরিবার ছিল এবং এই পরিবারের প্রধান ছিলেন জগৎশেঠ। জগৎশেঠ সামান্য অবস'া থেকে সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ ব্যাঙ্কার হয়ে উঠেছিলেন। সাম্রাজ্যের বহু স'ানে তার দালাল ছিল এবং সেখানে তারা লেনদেনের কাজ করত। এই সব দালালের মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যের শাসনকার্যের বিষয়ে অনেক তথ্য অবগত হতেন। বাংলাদেশে তার প্রভাব উচ্চপদস' রাজকর্মচারীর সমকক্ষ ছিল। তিনি জমিদার ও ইজারাদারদের দেয় রাজস্বের জন্য জামিন হতেন। দেশের যেকোনো অর্থ সঙ্কটে তার সাহায্যের প্রয়োজন হতো। নবাব আলীবর্দীর উদার পৃষ্ঠপোষকতার ফলে উমিচাঁদের ব্যবসায়ও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল।’
মুর্শিদাবাদের নবাবেরা মানবিক এবং পরধর্মসহিষ্ণুতার ইসলামী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েই হিন্দুদের প্রীতির চোখে দেখতেন। আর হিন্দু জমিদারেরা সবটুকু দেখতেন ষড়যন্ত্রের চোখে। এরই ফলে কাশিমবাজার কুঠি শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের আমন্ত্রণ করে আনার ষড়যন্ত্রশালার খ্যাতি পেয়েছিল। নবাবদের জাতীয় নীতির ফলে সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের উন্নতি হয়েছিল। শাসন ব্যাপারে তারা প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তবুও হিন্দু অভিজাত শ্রেণী অজানা ও রহস্যঘেরা কারণে মুসলমানদের শাসন মেনে নিতে পারেনি- তারা প্রভু পরিবর্তনের খেলায় মেতে ওঠে। তাদের সেই গোপন বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্রই পরে মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে ইংরেজদের প্রলুব্ধ করে। ব্যবসায় ও শিল্প প্রধানত হিন্দুদের হাতে থাকায় স্বভাবতই তাদের সাথে ইউরোপীয় বণিকদের সম্পর্ক স'াপিত হয়েছিল। ইউরোপীয় বণিকেরা ব্যবসায়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। ব্যবসায়িক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে হিন্দু ও ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে একপ্রকার মিত্রতা গড়ে উঠেছিল। হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী ও রাজস্ব কর্মকর্তারা যে মুসলিম শাসকদের রিুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন তার প্রমাণ মেলে এসসি হিলের এক চিঠিতে। তা ছাড়া হিলের ভাষ্য মতে, ১৭৫৪ সালে স্কট তার এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, ‘হিন্দু রাজা ও জমিদারগণ মূরদের (মুসলমানদের) শাসনে খুবই অসন'ষ্ট এবং তারা এই স্বেচ্ছাচারী শাসনের অবসানের জন্য সুযোগ অন্বেষণ করছেন।’ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবন-কাহিনী রচয়িতা রাজিবলোচন লিখেছেন, ‘হিন্দু জমিদার ও প্রধানগণ সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করবার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন।’
বাংলাদেশের বাণিজ্যে ইংরাজ বণিকেরা কয়েকটি বিশেষ সুবিধা লাভ করেছিলেন। সম্রাট শাহজাহান প্রথম ইংরেজদের হুগলিতে বাণিজ্যকেন্দ্র স'াপনের অনুমতি দেন। ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবাদার শাহজাদা সুজা মাত্র তিন হাজার টাকা বার্ষিক করের বিনিময়ে ইংরেজদের প্রদেশের সর্বত্র অবাধ বাণিজ্যের অধিকার প্রদান করে ‘নিশান’ জারি করেন। এই বিরাট সুবিধা লাভ করার ফলে ইংরেজ বণিকেরা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বন্দর ও শহরগুলোতে বাণিজ্যকেন্দ্র স'াপন করে একটি সমৃদ্ধ বণিক সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়ার সুযোগ পান। ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্যক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়ার খেসারতই পরে পলাশীর বিপর্যয় ডেকে আনে। স্বাধীনতা হারায় বাংলার জনগণ। যারা ইতিহাস-সচেতন ও দূরদর্শী তারা ইতিহাসের এ সবক’টি বিবেচনায় রাখতে চাইবেন- এটাই স্বাভাবিক। পরবর্তী লেখায় এ বিষয়ে আরো কিছু ইতিহাস অন্বেষার প্রত্যাশা রইল।
digantaeditorial@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন