পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১২

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

॥ মাসুদ মজুমদার ॥


নবাব, সম্রাট ও শাসকেরা ভবিষ্যৎ না ভেবে, ভুল করেই ইংরেজদের বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন। সেই সুযোগের অপব্যবহার করে স্বাধীনতা হরণের সুযোগ নিয়েছিল ইংরেজরা। এদের সাথে যোগ দিয়েছিল প্রভু পরিবর্তনকামী দেশীয় বিশ্বাসঘাতক বর্ণবাদী গোষ্ঠী। হয়তো এরাও ভাবতে পারেনি, তাদেরই বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বণিকের মানদণ্ড শাসনদণ্ডে রূপান্তরিত হবে। মুসলিম শাসকেরাও হয়তো এটা ভাবতে পারেননি, ইংরেজদের সহযোগিতা করবে সরকারেরই ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুবিধাভোগী হিন্দু কর্মকর্তা, দিওয়ান, ফৌজদার, মীরজাফর, জগৎশেঠ চক্র- যাদের বিশ্বাস করে মুসলিম শাসকেরা প্রধানমন্ত্রী, সিপাহসালার, ফৌজদার, দিওয়ান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদ দেয়া ছাড়াও নানা ধরনের বাড়তি সুবিধা দিয়েছিলেন। এরাই রাতারাতি প্রভু পরিবর্তনের খেলায় মেতে উঠল। ষড়যন্ত্রকে ষোলোকলায় পূর্ণ করল। ইংরেজদের সাহায্য করে বিশ্বাসঘাতকতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। নিজেরা সাজল বিশ্বাসহন্তা।
আগেই উল্লেখ করেছি, সম্রাট শাহজাহান প্রথম ইংরেজদের হুগলিতে বাণিজ্যকেন্দ্র স'াপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। সেটাকে উপমা ধরে বাংলার সুবাদার শাহজাদা সুজা বার্ষিক মাত্র তিন হাজার টাকা শুল্কের বিনিময়ে ইংরেজদের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় বাণিজ্যের অধিকার দিয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৬৫১ সালের কথা। তারই খেসারত দিতে হয়েছিল ১০৬ বছরের মাথায় পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধ নামের প্রহসন ও বিপর্যয়ের মাধ্যমে। স্বাধীনতা হারিয়ে পৌনে দুই শ’ বছর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ভোগের দায় ছিল সেসব বিশ্বাসঘাতক ও নতজানু শাসকদের।
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, কৌশলগত অবস'ান, জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ ও নিরাপত্তা আমলে না নিয়েই সম্রাট ও সুবাদারেরা ইংরেজদের বাড়তি সুবিধা দিয়েছিলেন। অনেক কিছু না ভেবেই সরলমনে বিশ্বাস করেছিলেন হিন্দু জমিদার, আমাত্য, আমলা ও ফৌজদারদের। তারাই বিশ্বাসভঙ্গ করে পুরো মুসলিম শাসনের ভিত টলিয়ে দিতে শেকড় কেটে দেয়। ইংরেজদের আমন্ত্রণ করে এনে ক্ষমতায় বসিয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়। অবশ্য ক্ষমতালোভী মীরজাফর, জগৎশেঠ চক্রও ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছিলেন ঘসেটি বেগম। যদিও ইংরেজদের বিশেষ সুবিধা দেয়া, অপরাপর ইউরোপীয় বণিকদের উপেক্ষা করা ছিল কূটনৈতিক অদূরদর্শিতাও। তা ছাড়া বাণিজ্য সনদ দেয়ার অনুমোদনটিও স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত ছিল না।
এর ফলে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক ও এ দেশের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছিল। একই সাথে ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করা হয়েছিল। কারণ অন্যদের দ্রব্যমূল্যের ওপর শতকরা সাড়ে তিন টাকা শুল্ক দিতে হতো। তা ছাড়া রাজকোষের শুল্কের ক্ষতি ছিল বেশুমার। প্রথম অবস'ায় বাংলাদেশে ইংরেজদের বাণিজ্যের পরিমাণ ও পরিসর ছিল অল্প। বাড়তি সুবিধা পেয়ে কয়েক বছরের মধ্যে তা বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। তাদের রাজনৈতিক অভিলাষও স্পষ্ট হতে থাকে। এসব বিবেচনা করেই সম্রাট আরোঙ্গজেব ইংরেজ বণিকদের বিশেষ সুবিধা রহিত করলেন। ইংরেজ বণিকেরা দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের প্রণোদনা পেয়ে এই ব্যবস'ার বিরুদ্ধচারণ করতে প্রয়াস পায়। ফলে স'ানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ বাধে। সুবাদার শায়েস্তা খান তাদের প্রতি কঠোর ব্যবস'া অবলম্বন করেন। ইংরেজদের বাড়াবাড়িমূলক আচরণ ও ধৃষ্টতার অভিযোগে বাংলাদেশ হতে তাদের বিতাড়িত করেন। পরে তারা নিজেদের আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়। শায়েস্তা খানের মহানুভবতায় আবার বাংলাদেশে ইংরেজেরা বিনয়ী হয়ে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। এ কারণেই শায়েস্তা খান এখনো বাংলার মানুষের কাছে নন্দিত ব্যক্তিত্ব।
সম্রাট ফররুখশিয়ার হেমিন্টন নামক একজন ইংরেজ চিকিৎসকের চিকিৎসায় সন'ষ্ট হয়ে তাকে কিছু ইনাম বা পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন। সুচতুর ইংরেজ চিকিৎসক নিজের জন্য কিছু না চেয়ে তার স্বজাতীয় বণিকদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রার্থনা করেন। সম্রাট ১৭১৫ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে মাত্র তিন হাজার টাকা বার্ষিক শুল্কের বিনিময়ে ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্যের অধিকার দান করেছিলেন, যা আগেই উল্লেখ করেছি। একতরফা বাণিজ্যের সুযোগ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ ও ঐশ্বর্যের বলে ইংরেজদের বাণিজ্য ফেঁপেফুলে ওঠে। বণিকেরা রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পায়। সাথে সহযোগী হিসেবে পায় হিন্দু জমিদারসহ আমাত্যদের।
বাণিজ্যে উন্নতির সাথে সাথে ইংরেজ বণিকদের মনে এ দেশে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষার উদয় হয়। হিন্দু ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্কের ফলে তারা বুঝতে পারে, তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা কার্যকর করতে এরা হিন্দু জমিদার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতা লাভ করতে সমর্থ হবে। নবাব আলীবর্দীর রাজত্বকালে কর্নেল স্কট নামের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোলন্দাজ বাহিনীর একজন ইঞ্জিনিয়ার বিলাতের কর্তৃপক্ষের কাছে এক পত্রে লিখেছিলেন, ‘যদি ইউরোপীয় সৈন্যরা ভালোভাবে অভিযান শুরু করে এবং হিন্দুদের উৎসাহিত করা হয়, তাহলে তারা ইংরেজদের সাথে যোগ দেবে।’ তিনি আরো লিখেছিলেন, এই কাজে উমিচাঁদ ও অন্য হিন্দু প্রধানদের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। হিন্দু জমিদার ও রাজকর্মচারীদের ওপর তাদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি আছে।
ইউরোপীয় অস্ত্রশস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে ইংরেজ বণিকদের দৃঢ় আস'া ছিল এবং হিন্দুদের সহযোগিতা সম্বন্ধেও তাদের আশা ও ভরসা দুটোই ছিল। এ জন্যই তারা আলীবর্দীর রাজত্বের শেষের দিকে ধৃষ্টতার সাথে নবাবের আদেশ উপেক্ষা করতে সাহসী হয়েছিল। আরো জানার বিষয় হচ্ছে, কলকাতায় ইংরেজদের জমিদারি ছিল, এরা এর সব অধিবাসীর ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করত। নবাব আলীবর্দী এ ব্যাপারে ইংরেজ বণিকদের কাছে একটি পরওয়ানা পাঠান। এরা পরওয়ানাবাহকের প্রতিও দুর্ব্যবহার করে। এখানেই তাদের ধৃষ্টতার শেষ নয়, তারা নবাবের কাছে অশ্লীল ভাষায় লিখিত এক পত্রে কলকাতার জনগণের ওপর তাদের সার্বভৌমত্ব দাবির বিষয়ে বাড়াবাড়িমূলক ব্যাখ্যা করে। এর কিছু দিন পরে আলীবর্দী খানের মৃত্যু হয়। এই জন্য সাহস ও দেশপ্রেমমূলক দৃঢ়তা থাকলেও আলীবর্দী খান বাধ্যক্যের কারণে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো রূপ ব্যবস'া অবলম্বন করতে পারেননি। সেটাই ছিল ষড়যন্ত্রের শেকড় উপড়ে ফেলার উপযুক্ত সময়- ইংরেজরা যার সদ্ব্যবহার করেছিল।
মাতামহের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালে তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে এক দিকে ইংরেজ বণিকদের অবাধ্যতা, শত্রুতা এবং অন্য দিকে স্বার্থান্বেষী আত্মীয়স্বজন ও রাজকর্মচারীদের ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়। আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘসেটি বেগম নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলেন। ক্ষমতালোভী সেনাপতি মীরজাফরও তার সাথে যোগ দিলেন। তারা সিরাজকে সিংহাসনচ্যুৎ করে সিরাজের খালাতো ভাই ও পুর্নিয়ার শাসনকর্তা শওকতজঙ্গকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসাতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। সে সময় ইংরেজ বণিকেরা নবাবের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সুযোগ পুরো মাত্রায় ছিল। তারা নবাবের কর্তৃত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাতে উৎসাহিত হয়। এ সম্পর্কে মিস্টা কুক লিখেছেন, সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনারোহণের সময় ইংরেজ বণিকেরা চলতি প্রথামত আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে নবাবকে কোনো উপঢৌকন পাঠায়নি। তা ছাড়া তারা নবাবের অনুমতি ছাড়াই কলকাতা দুর্গের আয়তন বাড়ায়। একই সাথে ফোর্ট উইলিয়ামকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সুরক্ষিত করে তোলে।
ইংরেজেরা বাহ্যত দেখায় যে, এরা ফরাসি বণিকদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এসব ব্যবস'া অবলম্বন করছে। কিন' নবাবের অনুমতি না নিয়ে তার রাজ্যে দুর্গ নির্মাণ ও যুদ্ধের আয়োজন করে। এরা নবাবের কর্তৃত্বের প্রতিও চরম ধৃষ্টতা ও উপেক্ষা প্রদর্শন করে। এ ছাড়া ইংরেজেরা দস্তক নামে বাণিজ্য সনদের সুবাদে পাওয়া সুবিধার অপব্যবহার করে। বাদশাহী ফরমানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টকে অধিকার দেয়া হয়েছিল, তিনি ইংরেজ বণিকদের ব্যবসায়ের জন্য অনুমতি পত্র দেবেন এবং দস্তকধারীদের তাদের পণ্যদ্রব্যের জন্য খেয়াঘাটে ও নদীতে শুল্ক দিতে হবে না। কোম্পানির ইংরেজ বণিক ছাড়াও তাদের কর্মচারী ও অন্য সমপ্রদায়ের বণিকেরা দস্তকের সুবিধা অপব্যবহার ও ভোগ করত। এর ফলে রাজকোষের শুল্কের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছিল। উল্লিখিত কারণ ছাড়াও নবাবের যেসব অসৎ ও বিদ্রোহী প্রজা তহবিল তসরুপ কিংবা রাজদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত হতো অথবা শাস্তির ভয়ে কলকাতায় পালাত ইংরেজ কোম্পানি তাদের আশ্রয় দিত। জাহাঙ্গীরনগরের দিওয়ান রাজা রাজবল্লভ রাজকোষের তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে তার অর্থসম্পদ ও পরিবারসহ পুত্র কৃষ্ণদাসকে কলকাতার ইংরেজদের দুর্গে আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়। নবাব ইংরেজদের বেআইনিভাবে দস্তক ব্যবহার বন্ধ করতে বলেন। বিনানুমতিতে দুর্গ নির্মাণ করতে নিষেধ করেন। কৃষ্ণদাসকে ফিরিয়ে দিতে ইংরেজদের আদেশ দেন। কোম্পানির কলকাতার গভর্নর মিস্টার ড্রেক নবাবের সব আদেশ অমান্য করে। অধিকন' নবাবের পাঠানো দূতের সাথে অসৌজন্য আচরণ করে।
বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য নবাব ইংরেজদের অবাধ্যতার শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ নিলেন। ১৭৫৬ সালের ৪ জুন তিনি তাদের কাসিমবাজার বাণিজ্য কুঠি দখল করে নেন। ২০ জুন তাদের কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গও অধিকার করেন। অনেক ইংরেজ কলকাতা ছেড়ে নদীতে ভাসমান জাহাজে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কিছু ইংরেজ নবাবের হাতে বন্দী হয়। মিস্টার কুক লিখেছেন, নবাব ইংরেজ বন্দীদের প্রতি কোনো রূপ দুর্ব্যবহার করেননি। মিস্টার ড্রেক উল্লেখ করেছেন, ভিন্ন কথা। হলওয়েল সামান্য ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে ‘অন্ধকূপ হত্যার’ কাহিনী সাজিয়েছিলেন।
কলকাতার পতনের পর ড্রেক ও অন্যান্য ইংরেজ সাহেব আশ্রয়হীন ও অসহায় হয়ে পড়ে। এ সময় এরা যদি উমিচাঁদ, নবকিষণ, জগৎশেঠ ও অন্যান্যের সাহায্য না পেত তা হলে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না। কয়েকজন হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ী পলাতক ইংরেজদের ফুলতায় আশ্রয় দেয় এবং তাদের জন্য গোপনে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করে।
কলকাতা পতনের খবর পেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজ কাউন্সিল রবার্ট ক্লাইভের অধীনে বাংলাদেশে সৈন্যদল ও নৌবহর পাঠায়। ক্লাইভ দাক্ষিণাত্যে ফরাসি বণিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে কর্ণাটকে ইংরেজ বণিকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটস ১৭৫৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর নৌবহর নিয়ে ভাগীরথী নদীতে প্রবেশ করে এবং ফুলতার দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় নবাবের ফৌজদার মানিকচাঁদ তাদের কোনো রূপ বাধা দেয়নি। এই সময়টিতে মানিকচাঁদ ও ক্লাইভের মধ্যে যে পত্র ও বার্তাবাহক বিনিময় হয় তা থেকে জানা যায়, মানিকচাঁদ নিজেকে ইংরেজদের একজন বন্ধু বলে প্রকাশ করে। ফলে ২ জানুয়ারি ১৭৫৭ সালে ক্লাইভ বিনা বাধায় সহজে কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এর পর ক্লাইভ হুগলি অধিকার করতেও কোনো বাধা পায়নি। মানিকচাঁদ ইরেজদের সাথে যুদ্ধ না করে কলকাতা ও হুগলি থেকে পূর্বপরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র মতো ইংরেজদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে নিজে সসৈন্য পিছু হটে যায়।
বাধ্য হয়ে নবাবকেই আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে হলো। ইরেজরা হুগলি ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। নবাব কলকাতার শহরতলিতে প্রবেশ করেন। ১৭৫৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ক্লাইভ ও ওয়াটস অতর্কিত নৈশ-আক্রমণে নবাবের সেনাছাউনিতে কিছুটা গোলযোগ সৃষ্টি করার সুযোগ নিলেও অবস'া প্রতিকূল বুঝে ক্লাইভ পালিয়ে যায়। কলকাতা অভিযানের পক্ষে নবাবের পর্যাপ্ত জনবল ও সৈন্য ছিল। কিন' তিনি নিজ সেনাকর্মকর্তাদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। এরা নবাবকে ইরেজদের সাথে আপস করতে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিল। এই সময় নবাবের আরেকটি বিপদের আশঙ্কা দেখা দেয়। আশঙ্কা করা হয়, আহমদ শাহ আবদালি বিহার আক্রমণে অগ্রসর হচ্ছেন। এতে নবাব মনের বল হারিয়ে ফেলেন। এক দিকে সেনাকর্মকর্তা ও ফৌজদার মানিক চাঁদ ইংরেজদের হয়ে কাজ করছিল, অন্য দিকে আহমদ শাহ আবদালির আক্রমণ শঙ্কা, বাধ্য হয়ে নবাব ১৭৫৭ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি ইংরেজদের সাথে সন্ধি করেন। এটাই বিখ্যাত ‘আলীনগরের সন্ধি’ নামে পরিচিতি।
ইংরেজেরা বাণিজ্যসুবিধা ফিরে পায়। কলকাতার দুর্গ সুরক্ষিত করার অনুমতিও তারা আদায় করে নেয়। এই সন্ধি করিয়ে নবাবকে যে দুর্বলতার পরিচয় দিতে বাধ্য করা হয় তারই পরিণতি ছিল অনিবার্য বিপর্যয়। যদি নবাব এই সময় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বিশ্বাসঘাতক সেনাধ্যক্ষদের শাস্তির ব্যবস'া করতে পারতেন, তাহলে তারা ভয় পেয়ে ষড়যন্ত্রমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হতো। কারণ তখনো ইংরেজরা সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারেনি। তাৎক্ষণিক কলকাতার দুর্গ আক্রমণ করলে নবাবের জয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। সব যড়যন্ত্র তখনই নিপাত যেত। বিশ্বাসঘাতক চক্রও খামোশ হয়ে যেতে বাধ্য হতো। বাংলার ইতিহাসও রচিত হতো ভিন্নভাবে।
ধুরন্ধর ইংরেজরা কেবল সাময়িকভাবে যুদ্ধবিরতির জন্য নবাবের সাথে সন্ধি করেছিল। মাত্র এক মাস পরেই এরা আলীনগরের সন্ধি ভঙ্গ করে। উল্লেখ্য, ১৭৫৬ থেকে ৬৩ সাল পর্যন্ত ইউরোপে তখন ‘সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ’ চলছিল। বাংলাদেশে ইংরেজরা ফরাসিদের চন্দরনগর বাণিজ্যকুঠি আক্রমণের জন্য প্রস'ত হয়। নবাব ইংরেজ ও ফরাসিদের তার রাজ্যে যুদ্ধ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। নবাবের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ক্লাইভ ২৩ মার্চ চন্দরনগর আক্রমণ করে দখল করে নেয়। হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সেনাপ্রধান রায়দুর্লভ ও মানিকচাঁদ ইংরেজদের সামান্যতম বাধা দিতে চেষ্টা করেনি। এ ব্যাপারে স্ক্রেফটন সাহেব লিখেছেন, ইংরেজরা উমিচাঁদকে দিয়ে নন্দকুমারকে এক হাজার ৫০০ টাকা ঘুষ দিয়েছিল। নন্দকুমার নবাবের সামরিক তথ্যও ইংরেজদের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছিল। তাতে ইংরেজদের শক্তি ও সাহস দুটোই বেড়ে যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য এক গোপন প্রস্তাব পাস করে। মিস্টার হিল লিখেছেন, ক্লাইভ উমিচাঁদকে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করেন। নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর নবাবের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন না। নবাব আলীবর্দীর সময় থেকেই মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কুখ্যাতি ছিল। তাকে কয়েকবার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নবাবের কাছে শাস্তিও পেতে হয়েছিল। মীরজাফর আলিবর্দীর ভগ্নিপতি ছিলেন। এই জন্য বৃদ্ধ নবাব তাকে ক্ষমা করে আবার সেনাপতি পদে বহাল করেন। কিন' মীরজাফরের স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি। মুর্শিদাবাদের মসনদের প্রতি তার লোভ ছিল। সিংহাসনের লোভে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে ষড়যন্ত্রকারীরা জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, মীরজাফর, রাজবল্লভ এবং আরো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সেই গোপন বৈঠকে যোগ দেন। ইংরেজ কোম্পানির অ্যাজেন্ট ওয়াটস মহিলাদের মতো পর্দাঘেরা পালকিতে চড়ে সেই বাড়িতে আসেন। সেখানেই বাংলার স্বাধীন নবাব ও স্বাধীনতার ভাগ্য নির্ধারণ করে ষড়যন্ত্রকারীরা।
আজকাল অনেক সন্ধি হচ্ছে। গোপন আঁতাত হচ্ছে। চুক্তি হচ্ছে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক সুবিধা পাইয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা এসব করছেন তারা অতীত ভাবছেন না। ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বিগ্ন নন। বাংলাদেশ আবার বিদেশীদের বাজারে পরিণত হলেও তাদের উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয় না। আজকের প্রেক্ষাপটে নন্দকুমার, মানিক চাঁদ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ ও মীরজাফর চক্রের মতো কারা কার স্বার্থের ক্রীড়নক তা-ও আমরা জানি না। শঙ্কা জাগে- ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে না তো?
কারণ কূটনৈতিক অদূরদর্শিতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। একতরফা বাণিজ্যিক সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ। গোপন বন্ধুত্বের অনেক তথ্যই অজ্ঞাত। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ ও বন্ধুত্বের কাছে হার মানছে। জাতি বিভক্ত। চার দিকে ষড়যন্ত্রের নানা গুজব। ব্যর্থতার নানা গুঞ্জন ও কাহিনী নিয়ে রাজনৈতিক ময়দান অসি'র। শাসকদের মেরুদণ্ড এবং ভবিষ্যৎ ভাবনাও প্রশ্নবিদ্ধ। তাই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির শঙ্কা জাগাটা অস্বাভাবিক না-ও হতে পারে।

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

ইতিহাসের সেই বাঁকে


॥ মাসুদ মজুমদার ॥

স্বাধীনতা ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এর স্বরূপ চিহ্নিত করা কঠিন হলেও জাতীয় স্বাধীনতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করা কঠিন নয়। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞান জাতীয় তথা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার স্বরূপ চিহ্নিত করে দিয়েছে। জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে। একটি জাতিসত্তা বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে সি'তি পায়। স্বাধীনতাও অর্জন করে অনেক পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে। এটা অর্জন করতে হয়। তাই স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়। আবার স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাসও রয়েছে। আমরাও একসময় স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম। এখন আমরা এ ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশীদার। আমাদের ইতিহাসে স্বাধীনতা অর্জন ও হারানোর কথা স্পষ্ট করে লেখা আছে।
আমাদের স্বাধীনতার একটি প্রলম্বিত ইতিহাসও আছে। একটা সময় আমরা স্বায়ত্তশাসিত ছিলাম। কিছু সময় আক্ষরিক স্বাধীনতাও আমাদের ছিল। তবে স্বশাসিত বলতে যা বুঝায় তা আংশিক ছিল ’৪৭ সালে, অবশিষ্টটুকু আমরা অর্জন করি ’৭১ সালে। দীর্ঘ সময় আমরা আবার পরাধীনও ছিলাম। আবার ’৪৭ সালে ব্রিটিশমুক্ত দেশ বিভাগের মাধ্যমে পাক-বাংলা-ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। এরপর শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ’৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমরা বাংলাদেশ অর্জন করলাম।
আজ যারা আমাদের ইতিহাস রচনায় ’৭১ সালকে ভিত্তি ধরেন, কিংবা ’৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত টেনে স্বাধীনতার গল্প শোনান, তারা আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করেন, শেকড়বিহীন একটি জাতিসত্তার কাহিনী রচনা করেন। তাতে আমরা শেকড়বিহীন হয়ে যাই।
আমাদের সব জাতীয় নেতা, বাংলাদেশের স'পতি, স্বাধীনতার ঘোষক, সর্বাধিনায়ক সবাই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। ইতিহাসের উত্তরাধিকার। তাদের অনেকেই ব্রিটিশ-মুক্তির মাধ্যমে আজাদি অর্জনের লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ অংশীদার। পাকিস্তান আমলেও তারা ছিলেন বরেণ্য ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তারা কেউ বৃন্তচ্যুত মানুষ নন। যারা আমাদের ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চান তারাই আমাদের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন করে দিতে অতি আগ্রহী। ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা বা আজাদির পঁয়ষট্টি বছর পালনের অংশীদার ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ। বাংলাদেশ সেই ইতিহাস কার স্বার্থে বিসর্জন দিতে যাবে। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা ব্রিটিশ মুক্তির বা স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামমুখর সমৃদ্ধ অতীত কাউকে কেউ দিয়ে দিতে পারে না, সেটাও ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের গৌরবময় অর্জন, স্বাধীনতার লাগাতার বা ধারাবাহিক ইতিহাসেরই অংশ। সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দিলে আমরা হয়ে যাবো পাক-ভারত যুদ্ধের বাই প্রোডাক্টর জনপদ- যা সত্যও নয়, বাস্তবও নয়। অথচ এই উপলব্ধি ও বোধ অনেকেরই নেই।
’৪৭ সালে একটি স্বাধীন দেশের অংশ হিসেবে মানচিত্র অঙ্কিত হয়েছিল বলেই আজ আমরা সেই মানচিত্রের গর্বিত উত্তরাধিকার। সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলা, বাঙালি, বাঙালি মুসলমান, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। ঢাকা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার রাজধানী। পশ্চিম বাংলা ভারতের অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশ। হিন্দির আধিপত্য ও দিল্লির শাসন তাদের ললাটের লিখন। ’৪৭ সালে ঢাকাকেন্দ্রিক এই মানচিত্র অঙ্কিত না হলে আজ আমরা পিন্ডি, ইসলামাবাদ কিংবা দিল্লির অধীন থাকতাম। স্বাধীনতার অহঙ্কার ও জাতিসত্তার আলাদা মর্যাদা অর্জন করা কতটা সম্ভব হতো পশ্চিম বাংলার পরিসি'তি পাঠ করে সেটা উপলব্ধি করার প্রয়োজন পড়ে। সেই পাঠ কিংবা অনুসন্ধান- পর্যবেক্ষণের দায় নতুন প্রজন্মের ওপর বর্তায়।
আমরা ইতিহাসের অতীত পর্বের সাথে আমাদের বর্তমানের যোগসূত্রের স্বরূপ অন্বেষণ করতে চাই। প্রাসঙ্গিকতায় মুসলিম শাসন ও ইংরেজ শাসনের সংক্ষিপ্ত স্বরূপও উন্মোচন করতে চাই। ইংরেজরা সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাণিজ্য করার লক্ষ্যে বাংলায় আগমন করে। ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর একটি রাজকীয় সনদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় দি ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরে কোম্পানি বাণিজ্য করার সুবাদে বাংলার শাসনক্ষমতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীন অস্তিত্ব হাতিয়ে নেয়। সেই ইতিহাসচর্চার আগে আমরা বাংলায় মুসলিম শাসনের ওপর খানিকটা আলোকপাত করতে পারি।
মূলত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে অর্থাৎ ১২ ’শ তিন কি চার সালে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলায় মুসলিম রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ও তার পরবর্তী শাসকেরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ শাসন করেছেন। তারা নামমাত্র দিল্লির সুলতানদের বশ্যতা স্বীকার করতেন। এরপর ১৩৪২ থেকে ১৩৫৭ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর হাজী শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ দিল্লির সাথে নামমাত্র সম্পর্কটুকুও ছিন্ন করে বাংলায় স্বাধীন রাজত্ব স'াপন করেন এবং স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করেন। এই সময় থেকে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল। এই স্বাধীন শাসনের আওতায় বাংলার রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত ঐক্যের পথ সুগম হয় এবং বাঙালির স্বতন্ত্র জাতীয় জীবন গড়ে উঠতে সুযোগ পায়। ১৫৪০ থেকে ৪৫ সাল পর্যন্ত শেরশাহের শাসনকালে কয়েক বছর আবার বাংলাদেশ দিল্লির সাথে সংযুক্ত ছিল। কিন' শেরশাহের মৃত্যুর পর কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ আবার এর স্বাধীন রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসে। পুনরায় মোগল সম্রাট আকবরের সময় আর একবার উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের সাথে স্বাধীন বাংলার সঙ্ঘাত বাধে। ১৫৭৬ সালে মোগল সৈন্যবাহিনী রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ কররানিকে পরাজিত ও নিহত করে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও মোগল সেনাপতিরা বহু বছর চেষ্টা করেও বাংলাদেশে সম্রাট আকবরের দিল্লিকেন্দ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বাংলার স্বাধীনতাপ্রিয় জমিদারেরা তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ১৬১১ সালে তার সুবাদার ইসলাম খানের কর্মকুশলতার ফলে বাংলার জমিদারেরা বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। আবার দিল্লির সাথে সংযোগ স'াপিত হয়।
সেই সুবাদে প্রায় শতাব্দীকাল বাংলাদেশ মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত সম্রাট আরওঙ্গজেব ভারতের শাসন পরিচালনা করেন। সম্রাট আরওঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তার বিশাল সাম্রাজ্য উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা, আমীর-ওমরার ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ প্রভৃতি কারণে বহুলাংশে ভেঙে পড়ে। এই সুযোগে বাংলাদেশে স্বাধীন শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭১৭ থেকে ২৭ সাল পর্যন্ত সুবাদার মুর্শিদ কুলী খান বাংলাদেশে স্বাধীন রাজত্ব স'াপন করেন। তিনি ও তার উত্তরাধিকারীগণের মধ্য থেকে সুজাউদ্দীন ১৭২৭-৩৯ সাল পর্যন্ত, সরফরাজ খান পরবর্তী এক বছর, আলীবর্দী খান ১৬ বছর ও সিরাজউদ্দৌলা মাত্র এক বছর নামমাত্র মোগল সম্রাটদের আনুগত্য স্বীকার করতেন। তারা বাংলার নবাব ও মুর্শিদাবাদের নবাব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মুর্শিদ কুলী খান ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে বাংলাদেশের রাজধানী স'ানান্তরিত করেন। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা মুর্শিদাবাদের নবাবদের রাজ্যভুক্ত ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবদের শাসনকালে বাংলাদেশ জাতীয় জীবন পুনর্গঠনে আবার সুযোগ পায়। এই সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা সঙ্ঘটিত হয়। মুসলমান শাসকশ্রেণী বাঙালির জাতীয় জীবনের সাথে মিশে যায়। মুর্শিদ কুলী ও তার উত্তরাধিকারীরা বাংলাদেশকে তার নিজের দেশ বলে গ্রহণ করেন এবং এখানকার অধিবাসীদের স্বার্থ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে এক হয়ে যান। তাদের আত্মীয়স্বজন, আমীর-ওমরা ও অনুচরেরা এবং ইরান-তুরান হতে আগত ভাগ্যান্বেষী ব্যবসায়ী, আলেম ওলামা ও অন্যান্য শ্রেণীর লোকজন বাংলাদেশে স'ায়ীভাবে বসতি স'াপন করেন। সেই সময় উত্তর ভারতে ও ইরানে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা চলছিল তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বহু ইরানি পরিবার নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। তারা ঐশ্বর্যশালী বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এর ফলে মুর্শিদাবাদ, হুগলি, ঢাকা ও অন্যান্য কয়েকটি শহরে ইরানি প্রভাবও পড়েছিল, যা আজো টিকে আছে।
মুর্শিদ কুলীর আগে বাংলাদেশ শাসনের জন্য উত্তর ভারত থেকে সুবাদার, দিউয়ান, বখশি ও অন্যান্য উচ্চপদস' কর্মচারী প্রেরিত হতেন। তারা আমলা হিসেবে স্বল্প মেয়াদে এই প্রদেশে আসতেন এবং মেয়াদ শেষে উত্তর ভারতে চলে যেতেন। এ জন্য বাংলাদেশের সাথে তাদের যোগসূত্র ছিল না। তাদের সাথে কিছু অর্থসম্পদও উত্তর ভারতে চলে যেত। নবাবদের আমলে এই পথ বন্ধ হয়ে যায়। তাদের সম্পদ বাংলাদেশের উপকারে আসে এবং স্বাধীন বাংলার স্বার্থের সাথে সবার স্বার্থ একসূত্রে গ্রথিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীন সুলতানদের মতো মুর্শিদাবাদের নবাবেরা দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত হয়ে বেশ কিছু জাতীয় নীতি অনুসরণ করে দেশের কল্যাণের জন্য চেষ্টা করেছেন। তারা বাঙালিদের প্রতিভার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক উন্নতির পথ সুগম করে দিয়েছেন। শাসনকার্যের বিভিন্ন পদে তারা ধর্মীয় বিভেদ না রেখেই বাঙালিদের নিয়োগ করতেন।
নবাবদের জাতীয় নীতির ফলে রাজকার্য, জমিদারি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হিন্দুদের বিশেষ উন্নতি হয়। মোগল আমলে বহু জায়গির ও জমিদারি মুসলমানদের দখলে ছিল। বড় বড় জায়গিরদার ও জমিদারদের বেশির ভাগই মুসলমান ছিলেন। মুর্শিদ কুলী অনেক মুসলমান কর্মচারীর জায়গির বাংলাদেশ থেকে উড়িষ্যায় স'ানান্তরিত করেন। কয়েকজন মুসলমান জমিদার রীতিমতো রাজস্ব আদায় করতে অসমর্থ হওয়ায় তিনি তাদের জমিদারি কেড়েও নেন এবং সেসব জমিদারি হিন্দুদের বন্দোবস্তি দেন। মাহমুদপুর বা নদীয়া-যশোর ও জালালপুর পরগনার কয়েকটি মুসলমান জমিদারি নাটোর জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা রামজীবনকে দেয়া হয়। সোনারগাঁওয়ের ঈসা খানের বংশধরদেরও কয়েকটি মূল্যবান পরগনা হারাতে হয়। মুর্শিদ কুলী তাদের জমিদারির আলপশাহী ও মোমেনশাহী পরগনা দু’টি কেড়ে নেন। দুইজন রাজস্ব কর্মচারীর সাথে পরগনা দু’টি বন্দোবস্তির ব্যবস'া করেন। এই ব্যবস'ার ফলে আলপশাহী ও মোমেনশাহীতে দু’টি প্রতাপশালী হিন্দু জমিদারির উৎপত্তি হয়। মুর্শিদ কুলী মনে করতেন হিন্দুরা স্বভাবত মুসলিম শাসকদের প্রতি অনুগত থাকেন। এ জন্য তিনি রাজস্ব ব্যবস'ার বিষয়ে হিন্দুদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করতেন। যদিও তার এই মনে করার সুযোগ নিয়ে হিন্দু জমিদারেরা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন এবং মুর্শিদ কুলী ও পরবর্তী নবাবদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেছেন। মুর্শিদ কুলীর পরবর্তী নবাবেরাও তার প্রদর্শিত নীতি অনুসরণ করে চলেন। এর ফলে বাংলাদেশের জমিদারিতে প্রায় এককভাবে হিন্দুদের প্রাধান্য স'াপিত হয়। এই প্রাধান্যের অপব্যবহার করে হিন্দু জমিদারেরা পরে ইংরেজদের সাথে সখ্য গড়ে তোলেন। তখনই এ দেশে একটি অভিজাত হিন্দু জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়। রাজশাহীর দিঘাপতিয়া ও নাটোর, ময়মনসিংহের মোমেনশাহী ও মুক্তাগাছা এবং দিনাজপুর, নদীয়া ও বর্ধমানের জমিদারিগুলো এর অন্যতম। এরাই পরে মুসলিম শাসকদের বিপক্ষে ইংরেজদের হয়ে ষড়যন্ত্র করার সুযোগ পান। অভিজাত হয়ে ওঠা হিন্দু জমিদারেরা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সহযোগিতাকে প্রভু পরিবর্তন হিসেবে দেখেছিলেন।
মুর্শিদ কুলী হিন্দুদিগকে রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বপূর্ণ পদেও নিয়োগ করেন। তার শাসনকালে ভূপৎ রায়, দর্পনারায়ণ, রঘুনন্দন, কিঙ্কর রায়, আলমচাঁদ, লাহারীমল, দিলপৎ সিংহ, হাজারীমল এবং আরো কয়েকজন হিন্দু দিউয়ান ও অন্যান্য উচ্চ পদে নিযুক্ত হন। মুর্শিদ কুলীর জামাতা ও উত্তরাধিকারী নবাব সুজাউদ্দিনের আমলেও আলমচাঁদ, জগৎশেঠ, যশোবন্ত রায়, রাজবল্লভ, নন্দলাল এবং আরো অনেক হিন্দু কর্মচারী দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নবাব আলীবর্দী খান একই নীতি বহাল রাখেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলাও তার মাতামহের নীতি অনুসরণ করেন। তিনি মোহনলালকে প্রধানমন্ত্রী ও জানকীরামকে দিউয়ানের পদে নিয়োগ করেন। রায়দুর্লভ, রামনারায়ণ, রাজবল্লভ ও অন্যান্য হিন্দু কর্মচারীরা দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা মানিকচাঁদ ও নন্দকুমারকে যথাক্রমে কলকাতা ও হুগলির ফৌজদার পদে নিয়োগ করেন। শেষ পর্যন্ত মোহনলাল ছাড়া আর কোনো হিন্দু জমিদার, আমলা, ঊর্ধ্বতন রাজ কর্মচারী ও ফৌজদার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পাশে দাঁড়াননি; বরং বিশ্বাসঘাতকতাকেই সুযোগ ভেবেছেন।
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও হিন্দুরা বিশেষ সুবিধা লাভ করেছিল। নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুর্শিদাবাদের শেঠ পরিবার ও কলকাতার উমিচাঁদ পরিবার ফেঁপেফুলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। জগৎশেঠ ছিলেন নবাব সরকারের ব্যাঙ্কার। সরকারি লেনদেনের কাজ করে তিনি বছরে সেই সময় এককভাবে চল্লিশ লাখ টাকা মুনাফা করতেন। জগৎশেঠের ঐশ্বর্যের বিষয়ে রবার্ট ওর্ম লিখেছেন, ‘মুকসুদাবাদে তথা মুর্শিদাবাদে এক হিন্দু পরিবার ছিল এবং এই পরিবারের প্রধান ছিলেন জগৎশেঠ। জগৎশেঠ সামান্য অবস'া থেকে সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ ব্যাঙ্কার হয়ে উঠেছিলেন। সাম্রাজ্যের বহু স'ানে তার দালাল ছিল এবং সেখানে তারা লেনদেনের কাজ করত। এই সব দালালের মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যের শাসনকার্যের বিষয়ে অনেক তথ্য অবগত হতেন। বাংলাদেশে তার প্রভাব উচ্চপদস' রাজকর্মচারীর সমকক্ষ ছিল। তিনি জমিদার ও ইজারাদারদের দেয় রাজস্বের জন্য জামিন হতেন। দেশের যেকোনো অর্থ সঙ্কটে তার সাহায্যের প্রয়োজন হতো। নবাব আলীবর্দীর উদার পৃষ্ঠপোষকতার ফলে উমিচাঁদের ব্যবসায়ও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল।’
মুর্শিদাবাদের নবাবেরা মানবিক এবং পরধর্মসহিষ্ণুতার ইসলামী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েই হিন্দুদের প্রীতির চোখে দেখতেন। আর হিন্দু জমিদারেরা সবটুকু দেখতেন ষড়যন্ত্রের চোখে। এরই ফলে কাশিমবাজার কুঠি শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের আমন্ত্রণ করে আনার ষড়যন্ত্রশালার খ্যাতি পেয়েছিল। নবাবদের জাতীয় নীতির ফলে সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের উন্নতি হয়েছিল। শাসন ব্যাপারে তারা প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তবুও হিন্দু অভিজাত শ্রেণী অজানা ও রহস্যঘেরা কারণে মুসলমানদের শাসন মেনে নিতে পারেনি- তারা প্রভু পরিবর্তনের খেলায় মেতে ওঠে। তাদের সেই গোপন বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্রই পরে মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে ইংরেজদের প্রলুব্ধ করে। ব্যবসায় ও শিল্প প্রধানত হিন্দুদের হাতে থাকায় স্বভাবতই তাদের সাথে ইউরোপীয় বণিকদের সম্পর্ক স'াপিত হয়েছিল। ইউরোপীয় বণিকেরা ব্যবসায়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। ব্যবসায়িক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে হিন্দু ও ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে একপ্রকার মিত্রতা গড়ে উঠেছিল। হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী ও রাজস্ব কর্মকর্তারা যে মুসলিম শাসকদের রিুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন তার প্রমাণ মেলে এসসি হিলের এক চিঠিতে। তা ছাড়া হিলের ভাষ্য মতে, ১৭৫৪ সালে স্কট তার এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, ‘হিন্দু রাজা ও জমিদারগণ মূরদের (মুসলমানদের) শাসনে খুবই অসন'ষ্ট এবং তারা এই স্বেচ্ছাচারী শাসনের অবসানের জন্য সুযোগ অন্বেষণ করছেন।’ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবন-কাহিনী রচয়িতা রাজিবলোচন লিখেছেন, ‘হিন্দু জমিদার ও প্রধানগণ সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করবার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন।’
বাংলাদেশের বাণিজ্যে ইংরাজ বণিকেরা কয়েকটি বিশেষ সুবিধা লাভ করেছিলেন। সম্রাট শাহজাহান প্রথম ইংরেজদের হুগলিতে বাণিজ্যকেন্দ্র স'াপনের অনুমতি দেন। ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবাদার শাহজাদা সুজা মাত্র তিন হাজার টাকা বার্ষিক করের বিনিময়ে ইংরেজদের প্রদেশের সর্বত্র অবাধ বাণিজ্যের অধিকার প্রদান করে ‘নিশান’ জারি করেন। এই বিরাট সুবিধা লাভ করার ফলে ইংরেজ বণিকেরা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বন্দর ও শহরগুলোতে বাণিজ্যকেন্দ্র স'াপন করে একটি সমৃদ্ধ বণিক সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়ার সুযোগ পান। ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্যক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়ার খেসারতই পরে পলাশীর বিপর্যয় ডেকে আনে। স্বাধীনতা হারায় বাংলার জনগণ। যারা ইতিহাস-সচেতন ও দূরদর্শী তারা ইতিহাসের এ সবক’টি বিবেচনায় রাখতে চাইবেন- এটাই স্বাভাবিক। পরবর্তী লেখায় এ বিষয়ে আরো কিছু ইতিহাস অন্বেষার প্রত্যাশা রইল।
digantaeditorial@gmail.com